নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার ধারাটিকেই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেই কারণেই বিদ্যালয়ে উপাসনার প্রচলন করেন তিনি। এই প্রথাটির সঙ্গে প্রাণের যোগ ছিল তাঁর। কিন্তু সেই প্রথাতেই যখন আগ্রহ দেখা গেল না একাধিক পড়ুয়া ও শিক্ষকের, তখন কী করেছিলেন গুরুদেব? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সময়টা ১৯৪০ সাল। কবিগুরুর জীবনপ্রদীপ তখন নিভু নিভু। অশক্ত শরীর। একাধিক শারীরিক সমস্যার জেরে বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করেছেন চিকিৎসকেরা। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন বিশ্রাম নেওয়ার কথা। এই পরিস্থিতিতে বাদ পড়েছে উপাসনায় নিয়মিত যোগ দেওয়ার অভ্যাস। উপাসনায় আচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন ক্ষিতিমোহন সেন, বেদ প্রসঙ্গে যাঁর জ্ঞান প্রশ্নাতীত। সুতরাং নিজে যেতে না পারলেও উপাসনায় কোনও ত্রুটি হবে না, এ কথা জেনে নিশ্চিন্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো তাঁর উপাসনায় যোগ না দিতে পারার দুঃখে প্রলেপ দিয়েছিল এই ভাবনাও, যে, তাঁকে ছাড়াও প্রবাহিত হবে তাঁর নির্দেশিত পথের ধারা। কিন্তু, বাস্তবে তেমনটা ঘটল না। কবির অনুপস্থিতির সুযোগে উপাসনায় যোগ দেওয়া বন্ধ করলেন একাধিক পড়ুয়া এবং শিক্ষক। তাঁদের যুক্তি ছিল, এ যুগে এসবের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের বড় সাধের উপাসনার মূল কথাই ছিল সকলের সঙ্গে সকলের অন্তরের যোগ। এবার ছেদ পড়ল সেই কথাতেই। পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের এক অংশকে নিয়েই চলতে লাগল উপাসনা।
আরও শুনুন: Rabindranath Tagore: ‘১০০০ বছরের পুরনো ডিম’ রবীন্দ্রনাথের পাতে, তারপর…
স্বাভাবিকভাবেই এ কথা কানে উঠল রবীন্দ্রনাথের। শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন কবি। উপাসনার সঙ্গে প্রাণের যোগ ছিল তাঁর। আসলে রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত পরিবেশে বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন, তার মূল সুরটি তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার আদর্শে। কোনওরকম সংকীর্ণতা কিংবা ধর্মীয় গণ্ডি নয়- বরং এ দেশে চিন্তা আর দর্শনের যে ধারা প্রবাহিত ছিল, মন এবং মননের মধ্যে ছিল যে অবিচ্ছিন্ন যোগ, সেই আদর্শকেই ফিরে দেখতে চেয়েছিলেন গুরুদেব। আর সেই কারণেই প্রতি বুধবার সকালে বিদ্যালয়ে পালিত হত এক অনুষ্ঠান, যার নাম মন্দির। উপাসনা ছিল এই অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। সকলে একসঙ্গে ধ্যান করতেন কিছু সময়, আর সমবেত কণ্ঠে আবৃত্তি করা হত বেদমন্ত্র। স্পষ্ট বাংলায় সেসবের ভাবার্থ বুঝিয়ে দিতেন কবি নিজেই। আর এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত হবে এ দেশের দর্শনের ঐতিহ্য, এমনটাই আশা ছিল তাঁর।
আরও শুনুন: কাকা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
যখন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-পড়ুয়াদের এক অংশ নিজেদের সরিয়ে নিলেন উপাসনা থেকে, রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন তাঁর আশা আর বাস্তবের মধ্যে ফাঁক রয়ে গিয়েছে কোথাও। কিন্তু হতাশায় ভেঙে পড়া তাঁর স্বভাবে ছিল না। তাই রুগ্ন শরীরেও তিনি স্থির করলেন, হাল ধরতে হবে তাঁকেই। যিনি আজীবন কাজকেই ধর্ম বলে জেনে এসেছেন, জীবনের শেষ লগ্নে পৌঁছে সে ধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হবেন কেমন করে! তাই ১৯৪০ সালের ২৪ জুলাই, উপাসনাগৃহের সামনে দেখা গেল চেনা গাড়িটি। ভেতরে বসে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। উপাসনা শুরু হতে তখনও দেরি আছে অনেক। কিন্তু চিকিৎসকদের নিষেধ উড়িয়ে জোর করেই সেদিন চলে এসেছিলেন কবি। শুধু তাই নয়, কবি জানিয়েছিলেন, আগের মতো প্রতি উপাসনাতেই উপস্থিত থাকবেন তিনি।
আরও শুনুন: পোলাও কই? প্রশ্ন ছোট্ট নবনীতার, খুদে অতিথির মানরক্ষায় উদ্যোগী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
সেদিন সকলের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “একাগ্রচিত্তে সর্বদা আকাঙ্ক্ষা করেছি, বর্তমান কালের তুচ্ছতা ইতরতা প্রগলভতা সমস্ত দূর করতে হবে। যাদের শিক্ষাদানের ভার গ্রহণ করেছি, ভারতের যুগান্তকারী সাধনার অমৃত-উৎসে তাদের পৌঁছে দিতে পারব, এই আশাই ছিল অন্তরের গভীরে।” সেদিন শিক্ষার সঙ্গে শ্রদ্ধার একান্ত যোগের কথাটিও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যা কিছু ত্রুটি, অপারগতা রয়ে গিয়েছে, তার দায় কেবল অন্যপক্ষের উপর চাপিয়ে দিতে চাননি তিনি। বরং তার সমান ভার নিয়েছিলেন নিজেও। আর এভাবেই, জীবনের শেষ বছরে দাঁড়িয়েও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছিলেন শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ।