মানুষের পৃথিবীতে জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের হরেক কুঠুরি। সে পৃথিবীতে শিল্পীকেও কখনও কখনও মাপা হয় ধর্মের পাত্রে রেখেই। কিন্তু শিল্পীর গন্তব্য কি সেখানেই থেমে যায়? উত্তর দিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
কবীর সুমন কথায় কথায় বলেছিলেন, মার্কিন ভূমিতে এক আফ্রো-আমেরিকান ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা। যিনি বলেছিলেন, রবিশঙ্করের দেশের মানুষের কাছ থেকে তিনি ভাড়া নিতে পারবেন না। পণ্ডিত রবিশঙ্করের জনপ্রিয়তা এমনই। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে, ক্লাসিকাল সংগীত চর্চার বোদ্ধামহল পেরিয়ে যে কোনও অনুভবী শ্রোতার মনে তাঁর অবাধ যাতায়াত। কিন্তু সেই শীর্ষে পৌঁছনোর শুরুটা কিন্তু তাঁর পক্ষেও সহজ ছিল না। সেই গড়ে ওঠার পর্যায়ে কম দুঃখ পেতে হয়নি তাঁকে। এমনই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল যে, একসময় ভেবেছিলেন নিজের পিতৃদত্ত নামটাই পালটে ফেলবেন। রবিশঙ্কর থেকে হয়ে যাবেন রব্বন খাঁ। না, স্বেচ্ছায় সে কথা ভাবেননি রবিশঙ্কর। ভেবেছিলেন রাগে দুঃখে। কিন্তু কেন? পণ্ডিতজি বলেছিলেন, আসলে অনেকেরই মনে এই ধারণা কায়েম হয়ে আছে যে, “মুসলমান শিল্পী না হলে, বা নামের পেছনে একটা খাঁ না থাকলে তাঁর গান-বাজনায় সে জৌলুস বা রং আসতেই পারে না।” এমনকি অনেককে তিনি এমন টিপ্পনী কাটতেও শুনেছিলেন যে, “পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ না থাকলে আর গান হল কী করে!” নিখাদ বাঙালি রবিশঙ্করের সংগীতপ্রতিভাই প্রশ্নের মুখে পড়েছিল এহেন গোঁড়া ধারণার সামনে। আর সেই যন্ত্রণাতেই একসময় নামবদলের কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন পণ্ডিতজি।
আরও শুনুন:
দুর্ভাগা সেই দেশ… সম্প্রীতির প্রয়োজনে শিল্পীর বন্ধুতাও যেখানে মাপা হয় ধর্মের পরিচয়ে
আসলে ওই ধারণাটা যে সম্পূর্ণ ভুল, তেমন কথাও কিন্তু বলতে চাননি রবিশঙ্কর। বরং তিনি নিজেই বলেন, বহুদিন পর্যন্ত এ দেশের নামী গাইয়ে বাজিয়েদের অধিকাংশই ছিলেন ধর্মে মুসলমান। ‘রাগ-অনুরাগ’ বইয়ে তিনি স্বীকার করেছিলেন, “আমি যখন থেকে, এই ধর ১৯৩৯-৪০ সাল থেকে, গান-বাজনার লাইনে নামলাম তখনই দেখলাম যে, হিন্দুস্থানী সংগীতের ক্ষেত্রে- এক কাশী, বিহার এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চল বাদ দিয়ে- একেবারে মুসলমান শিল্পীদের প্রাধান্য। তাঁদের এবং তাঁদের ভক্তবর্গকে নিয়ে এমন একটা জোট ছিল চারিদিকে যে, তার মধ্যে দিয়ে গলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো খুব মুশকিলের ব্যাপার ছিল কোনও হিন্দু শিল্পীর পক্ষে।” কিন্তু শিল্পীর ধর্ম যাই হোক না কেন, তাঁরা যে সংগীতের চর্চা করছেন তা যে এ দেশেরই আদি ও অকৃত্রিম সম্পত্তি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর।
আরও শুনুন:
ধর্মপরিচয় প্রধান নয়, তিনি বাঙালি… স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন বাঙালির আইকন সত্যজিৎ
সত্যি বলতে, মানুষের পৃথিবীতে মানচিত্রের বিভাজন। জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের হরেক কুঠুরি। কিন্তু সে বিভাজনদুষ্ট পৃথিবীতে সংগীত যেন পরম উপশম। তা সমস্ত বিভাজন মুছে এক সাম্যের কথাই বলে। ধর্মের বিদ্বেষ মুছে সংগীত মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে সেই গন্তব্যে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আঙিনাগুলো মুছে গিয়ে জেগে থাকে মানুষের ধর্ম। বড় মাপের শিল্পীরা শেষ পর্যন্ত চিনে নেন সেই গন্তব্যকেই। যেমন চিনেছিলেন রবিশঙ্করও। কোনও ধর্ম বা মত দিয়ে নয়, অক্লান্ত অনলস চর্চা দিয়েই যে একমাত্র সংগীতের ভূমিতে দাঁড়ানোর অধিকার মেলে, সে কথা তিনি নিজেও জেনেছিলেন, আর বুঝিয়েও দিয়েছিলেন সে কথা। শাস্ত্রীয় সংগীতের নামী ওস্তাদেরা যে অনেকেই মুসলমান, এ প্রসঙ্গে অন্য সব যুক্তি সরিয়ে তিনি বলেছিলেন তাঁদের মধ্যে থাকা প্রচণ্ড জেদের কথা। জানিয়েছিলেন, মুসলমান শিল্পীদের মধ্যে চিল্লা নেওয়া বলে এক রীতি ছিল। যেখানে গাইয়ে বা যন্ত্রী একটা বিশেষ তান নিয়ে ৯ দিন, ২১ দিন কি ৪০ দিনের চিল্লা নিতেন। অর্থাৎ একটা ছোট্ট ঘরে বসে, চতুর্দিক বন্ধ করে শুধু ওই একটি বিষয়ের মধ্যেই নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দেওয়া। সব কিছু ভুলে, সব কিছু ত্যাগ করে অমন সাধনা যিনি করতে পারেন, সেই বিশেষ চর্চার উপর তাঁর নিজস্ব দাপট ও অধিকার তো জন্মানোরই কথা- নির্দ্বিধায় এ কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন পণ্ডিতজি। সাফ বলেছিলেন, “এখানে হিন্দু হওয়া বা মুসলমান হওয়া নিয়ে কোনও কথাই উঠছে না। আমরা যদি মার খেয়ে থাকি তা একমাত্র রেওয়াজ, জেদ এবং কঠোর সাধনার অভাবে।” একসময় রাগে দুঃখে নাম পরিবর্তনের কথা পর্যন্ত যিনি ভেবে ফেলেছিলেন, সারাজীবনের সাধনার মধ্যে দিয়েই এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন তিনি। আর ভাবী কালের সামনে সেই উপলব্ধির ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি নিজেই। রবিশঙ্করের দেশেই আজ যখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছেয়ে আসে, যখন শিল্পীকেও মাপা হয় ধর্মের পাত্রে রেখে, তখন এই উপলব্ধিই যেন পথ দেখাতে পারে আমাদের।