কমল চক্রবর্তীর সংজ্ঞা কমল চক্রবর্তী। কমল চক্রবর্তীর তুলনা কমল চক্রবর্তী। কমল চক্রবর্তীর বিকল্প কমল চক্রবর্তী। অথবা হাজার হাজার বছরের বৃক্ষ। গভীর চলাচলে প্রাণময়, রসময়। জীবনের সম্পদ ও সম্পাদনা। এলোমেলো মেলে রাখা ভাবনার শস্য, ভাঙাগড়ার সমূহ সম্ভাবনা। কমল চক্রবর্তীর অতীত কমল চক্রবর্তী। কমল চক্রবর্তীর আগামী? প্রশ্নচিহ্নে পিছু ফিরে তাকাবে সময়। ফিরে পাবে কালির উৎসব। সাবধানী পাণ্ডুলিপি আর অভিমানী চোখ।
স্মৃতির আলপথে সম্বিত বসু। মনে পড়া সেইসব কথা পড়ে শোনালেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মারাদোনা। রক্তমাংসের নয়, অক্ষরে ছাপা। সেই মারাদোনাকে গড়ে তুলেছিল কমলদাই। বইখানা হারিয়ে গিয়েছে। কে বা কারা লুটে নিয়েছে। কত বই-ই তো হাতফেরতা হয়ে যায়। কিন্তু মারাদোনাকে ফিরে পেয়েছিলাম, খানিক পরে, কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায়, শুয়ে থাকা অসংখ্য বইয়ের ভিড়ে। কৌরব পত্রিকার ভেতর নিজের বিশ্ব নিয়ে, চিতসাঁতার কাটছিল মারাদোনা। হাতে নিয়ে ফোন করেছিলাম কমলদাকে।
‘কমলদা, একটা জায়গা শুনবে?’ তারপর পড়লাম, হুবহু:
‘‘একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের যন্ত্রণা বোঝার ক্ষমতা পৃথিবীর শত শত ক্লাবঘরের নিশ্চয় আছে। কিন্তু একজন ফুটবল শিল্পীর তুলির আঁচড় বোঝার ক্ষমতা ঐ হ্যাভালঞ্জ বা তোমার হত্যাকারীদের নেই। দেখ পৃথিবী থেকে শেক্সপীয়ার, ভ্যান গখ্, মাতিস, সিষ্টিন চ্যাপেল, এলিয়ট সব উপড়ে জলে ফেলে দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। শুধু উপড়ে ফেলার আবহ।’, কেমন কমলদা?’’
‘কোথায় পেলি তুই! কোথায় পেলি! এ তো মারাদোনা! লিখেছিলাম সেই কবে!’
‘রাস্তায় কমলদা। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে। কৌরব কোথা থেকে এসে পড়েছে। কোন কবি না জানি মারা গেলেন আবার!’
‘আমার কাছে কিছু নেই এসব। তবে দেখিস, এখানে মারাদোনা শুধু ফুটবল প্লেয়ার নয়, মারাদোনা কবি, মারাদোনা শিল্পী– দানব। কিন্তু কে মারা গেল? কোন বন্ধু? পাঠক?’
‘জানি না কমলদা। কিচ্ছু লেখা নেই এই কৌরবটায়।’
এ ঘটনা ঘটছে ২০১৫-’১৬ সালের কোনও মাঝদুপুরে। তার বেশ কিছুকাল আগেই ‘কৌরব’ পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেছে। বছর তিন-চার আগেই তো, ওই ’১১-’১২ সালে সম্ভবত, বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের কাছেই ছিল কৌরব-এর স্টল। সেখানে মুখে হাসি নিয়ে ভারী চেহারায় হাজির ছিলেন বারীন ঘোষাল। অনেক সময়ই চেক শার্ট। একটা চেয়ারে বসে। আর কমলদা, তখন দূরত্বভরা দা-সম্বোধনহীন কমল চক্রবর্তী। বসে, দাঁড়িয়ে। বারবার স্টলের মাথায় কৌরব লেখাটার দিকে তাকিয়েছিলেন। যেন দূরের নক্ষত্র, যেন মেঘে ঢেকে যাচ্ছে বারবার। কমলদাই, সেই মেঘ সরিয়ে সরিয়ে বের করে আনছেন কৌরবকে। কমলদা ধুতিপরিহিত ক্যাটক্যাটে স্মার্ট। গাছেদের সুপারিনটেন্ডেন্ট। চোখের মণি সবসময়ই ভুরুর দিকে তাক করা। নিজের কপালে কী আছে, সারাক্ষণই দেখতে চাইছেন এবং বাংলা কবিতা-গদ্য-লিটল ম্যাগাজিনের মতো সেই নিয়তিকে ভাঙতেও চাইছেন ওই ভুরু কোঁচকানো দিয়ে। বারেবারে কৌরব যাই তখন। ছুটকোছাটকা বন্ধুও জুটে গেছে। উদয়ন ঘোষের নতুন কী এল, খালাসিটোলা সংখ্যাটা পাওয়া যাচ্ছে কি না, অবশ্যই কেজি– কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের নতুন কিছু এ চত্বরে ঝরে পড়ল কি? এবং জীবিত লেখকের প্রতি খানিক অবহেলা ও স্পর্শযোগ্যতা নিয়ে কমলদার বই খোঁজাখুঁজি করা। বিশেষ করে, পুরনো প্রিন্ট, কমদামে যদি কিছু পাওয়া যায়।
তখনও জানতাম না একদিন এই কমল চক্রবর্তীকেই বাগে পাব। যদিও বাগে পাইনি। লড়াই হয়েছে সমানে-সমানে। ‘রোববার’ পত্রিকায় ‘কৃত্তিবাসী’ কলামের দায়িত্ব প্রথম থেকেই এসে পড়েছিল আমার ঘাড়ে। ফলে কমলদাকে ফোন করা, তাড়া দেওয়া, প্রুফ দেখা এবং যেহেতু গোটা ‘কৃত্তিবাসী’ জুড়েই ছিল কবি-গদ্যকার-লিটল ম্যাগাজিন করিয়েদের আক্ষরিক পৃথিবী, তাই সেসবের ছবির জোগাড়যন্তরও করতে হত। এ ব্যাপারে আমাকে পুরোদস্তুর সাহায্য করেছিলেন কবি ও ‘উলুখড়’ পত্রিকার সম্পাদক অরণি বসু। কমলদা বহুবার সেইসব লেখার সঙ্গে পুরনো দিনের পত্রিকার ছবি ও লেখকদের ছবি দেখে বিস্মিত হয়ে ফোন করেছে। কী উচ্ছ্বাস সেই গলায়!
কমলদা, কিছু সময় মেল করত। পাতার ছবি তুলে। আর কিছু সময় হাতে সেই লেখার পাণ্ডুলিপিখানা নিয়ে হাজির হত চাঁদনি চকে, আমাদের অফিসপাড়ায়। কিছুতেই ওপরে যাবে না, ফলে নামতে হবে রাস্তাতেই। দেখামাত্র, ‘নে নে তোর পাণ্ডুলিপি– উদ্ধার কর আমাকে।’ নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। পকেট থেকে হয়তো লম্বা ফুলস্কেপ কাগজের মাথাটুকু বেরিয়ে।
বললাম, ‘চা খাবে?’
‘চ, খাই।’
মনোজদের চায়ের দোকান থেকে দুটো বড় চা হাতে, শুনে নিই এই পাণ্ডুলিপিতে কী রয়েছে। কখনও কৃষ্ণগোপাল, অধুনা প্রেস, নিজের রক্ত বেচে কৌরবের জন্য টাকা তোলা। কখনও সুনীল-শক্তি-সন্দীপন-ভাস্কর-উৎপল-খালাসিটোলা। কখনও আবার জামশেদপুর, জঙ্গল। কখনও গতকালের আক্ষেপানুরাগ: এক বাংলাদেশি তরুণী তাঁর চোখের কাজল লাগা রুমাল উপহার দিয়ে বলেছে, ‘আপনার মতো সুন্দর আর দু’টি দেখিনি।’ এবং, পরের এপিসোডে কী লিখছে, তার ঝকঝকে বর্ণনা। কিন্তু এতসব কথার মধ্যে কমলদার ওই ভুরুতে টিপ করা চোখ, বারবার আমার পকেটের পাণ্ডুলিপিতে নেমে এসেছে। চা এমনভাবেই খাচ্ছে, যে, ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে, দাড়ি দিয়ে অল্প ফোঁটা ফোঁটা হলুদ পাঞ্জাবিতেও। কমলদার তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। চা খাওয়া শেষ।
‘চলি তবে?’ বলল, ‘সাবধানে নিয়ে যাস বাবা, ফেলে দিস না।’
সাত কদম দূর ওই চায়ের দোকান আর অফিস। তারই মধ্যে কমলদা ভাবছে, হারিয়ে যাবে তার পাণ্ডুলিপি। তার সকালবেলার লেখা। সাদা ফুলস্কেপ কাগজে, হাতের হইহই করে লেখা, কালির উৎসব, প্রতি পঙ্ক্তির ভিতর হাজার বছরের গাছ। আর রাগী চোখের জল। এবং সে চোখে, অনেক পুরস্কার, স্বীকৃতির পরও, আমাকে তোরা পাত্তা দিলি না– এই অভিমানটুকু এক পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওয়া দিলেও, সে সামান্যতম দোলে না।
খাঁটি কবিরা যেখানে যেখানে জেগেছে, এককালে, কমলদা সেখানে কৌরব-এর চারা পুঁতে এসেছে। বাংলা গদ্যের থুতনি ধরে নাড়িয়ে দিতে পারে যে গদ্যকাররা, তাদের অবিলম্বে পাকড়াও করেছিল কৌরব। শুধু তাই-ই নয়, কবিদের দিয়ে, গদ্যকারদের দিয়ে পত্রিকার প্রচ্ছদ পর্যন্ত করিয়ে ছেড়েছে! সে বিনয় মজুমদার হোক কিংবা শক্তি-সুনীল-কমলকুমার। পাশাপাশি রবীন মণ্ডল কিংবা যোগেন চৌধুরীও করেছেন এই কৌরবের প্রচ্ছদ। কৌরব– তবু অভিযোগময়। কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, যিনি নিজেকে একইসঙ্গে কৌরবের ধাইমা ও ডোম বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, তিনিই অভিযোগ আনেন কৌরব-এর দুর্বল সম্পাদনার। বলেন, যেভাবে তৈরি হয়েছিল কৌরব, যে কলার ওঁচানো তীব্রতা ছিল সারা পত্রিকা জুড়ে– খ্যাতির পর সেই তেজ-পাতাগুলি আর সেভাবে দেখা গেল না।
কমলদা, আজ সকালবেলায় তুমি লিখতে বসোনি। কৃত্তিবাসী লেখা দীর্ঘদিন হল শেষ হয়ে গেছে। তুমি জানিয়েছিলে, এক বিখ্যাত প্রকাশক কৃত্তিবাসীর পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছে, তুমি সযত্নে জমা দেওয়ার পরও। কথাও হল, আমি নাহয় কৃত্তিবাসীগুলো একজোট করে দেব।
তুমি, আরেকটু দূর থেকে আগের মতোই সেই পাণ্ডুলিপির ওপর আবারও নজর রাখবে তো?