রবীন্দ্রনাথ যে বলছেন ‘বঙ্গসমাজে বিপ্লবের আগ্নেয় উচ্ছ্বাস সর্বপ্রথমে’ তিনি উৎসারিত করলেন, তা শুধু তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্যই নয়। কর্মপদ্ধতির জন্যেও। অতএব আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনি তো স্থিরচিত্তে ভালোমন্দ সমস্ত পর্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি তখনকার অন্ধকার হিন্দুসমাজে আলোক জ্বালাইয়া দিলেন, কিন্তু চিতালোক তো জ্বালান নাই। ইহাই রামমোহন রায়ের প্রধান মহত্ত্ব।’ যখন ধর্ম-সংস্কার-রাজনীতি মিলেমিশে জনজীবন একই সঙ্গে আহত এবং বিভ্রান্ত, তখন আমাদের এই আলোক আর চিতালোকের পার্থক্য বুঝে নেওয়াটাই বোধহয় সবথেকে জরুরি কাজ।
বাঙালিকে যদি কেউ অবহেলা করে তাহলে তার জবাব কী? রবীন্দ্রনাথ আমাদের একটি উত্তর শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। এরকম প্রশ্নের মুখে পড়লে বাঙালিরা অনায়াসে বলতে পারে, ‘রামমোহন রায় বাঙালি ছিলেন’। কেন? রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি। তিনি আমাদের জন্য যে কত করিয়াছেন, কত করিতে পারিয়াছেন, তাহা ভালো করিয়া আলোচনা করিয়া দেখিলে তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও স্বজাতির প্রতি বিশ্বাস জন্মিবে।’
তবে এই ভক্তি তাঁকে অবতার হিসাবে পুজো করবার জন্য অবশ্যই নয়। বা, তিনি আজ থাকলে কী করতেন বা না-করতেন, তা নিয়ে আক্ষেপ করাও অর্থহীন। বরং তিনি কী করেছেন, তাঁর কর্মের অভিমুখ কোনটি, তা শনাক্ত করলেই বাঙালির মঙ্গল। শুধু সতীদাহ প্রথা রদের মধ্যেই তাঁকে সীমায়িত করা চলে না। আবার এই একটি কাজের দিকে তাকালেও যেন রামমোহন রায়ের কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক গতিপথটি অনুমান করে নেওয়া যায়। সতী প্রথার বিরুদ্ধে সেই সময় যে প্রচার শুরু হয়েছিল, রামমোহন সেই আন্দোলনকে সঠিক দিশা দিলেন বলা যায়। এই প্রথার প্রেক্ষাপট ফিরে দেখলে রামমোহনের কাজের পদ্ধতিটিও অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আরও শুনুন: ডাল-ভাতের ব্যবস্থা না করে সাহিত্য নয়, বলেছিলেন ‘অভিমানী’ মানিক
দেখা যায়, আর্য সংস্কৃতির যে মূল উৎস, সেই বেদে কিন্তু সতীদাহের মতো কোনও অনুশাসনের উল্লেখ ছিল না। সতীদাহের উদ্ভব হল, বলা যায়, শাস্ত্রের ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা থেকেই। ইতিহাসবিদ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সতীদাহ প্রথা উদ্ভবের পিছনে যে মস্ত অর্থনৈতিক কারণ ছিল, সেই প্রসঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন- ‘টমসন নামে জনৈক ইংরেজ একবার গণনা করে দেখিয়েছিলেন যে, হিন্দুধর্মের সনাতনবাদীদের পীঠস্থান বারাণসীতে সতীদাহের সংখ্যা ছিল দেড় সহস্র অথচ বাংলাদেশে তার সংখ্যা তখন সাড়ে তিন সহস্র। এর কারণও খুব সুষ্পষ্ট। … বারাণসীতে সন্তানহীনা বিধবার সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত ছিল না। অথচ জীমূতবাহনের দায়ভাগশাসিত বাংলাদেশে সন্তানহীনা বিধবার আজীবন সম্পত্তির অধিকার ছিল স্বীকৃত।’ এই তথ্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঠিক কোন স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য অসংখ্য সন্তানহীনা বিধবা রমণীকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল স্বামীর চিতায়। তবে সেই পুরোটাই হয়েছিল শাস্ত্রের মোড়কে। বলা যায় শাস্ত্রকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। পুরোহিততন্ত্র যা চাইছিল, তার রূপায়ণ হল নিবন্ধ-লেখক রঘুনন্দনের হাত ধরে। কিন্তু বহু শাস্ত্র মন্ত্রন করেও তিনি এই অনুশাসনের কোনও উল্লেখ পাননি। ভূপেন্দ্রনাথ বলেন, এরপরই তিনি ‘একটি শ্লোকে ভেজাল আমদানি করলেন’। ঋগবেদের যে শ্লোকটিকে বদলে দেন রঘুনন্দন, সেটির অর্থ ছিল, ‘হে সমবেত সুবেশা রমণীগণ, তোমরা সম্মুখস্থ কক্ষে প্রবেশ করো।’ ভূপেন্দ্রনাথ লিখছেন, “রঘুনন্দন এই শ্লোকটিকে জাল করে লিখলেন হে রমণীগণ তোমরা সম্মুখস্থ অগ্নিকক্ষে অর্থাৎ চিতায় প্রবেশ করো।” অবশ্য অশ্বত্থামা হত ইতি গজ করে তিনি জুড়ে দয়েছিলেন যে, যাঁরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করতে চাইবেন, তাঁরাই চিতায় প্রবেশ করবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে রমণীগণের ইচ্ছার যে কোনও গুরুত্বই ছিল না এবং এর যে কী ভয়াবহ পরিণাম হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী আছে। রামমোহনও ছিলেন।
আরও শুনুন: হিন্দু ধর্মকে আঘাতের অভিযোগ! কী উত্তর দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়?
রামমোহন সংস্কারের পক্ষে, তবে জোর করে যে কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন, তা তো নয়। চাইলে তিনি পারতেন, কিন্তু করেননি। রামমোহনের এই দর্শনের সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ- ‘তিনি গড়িয়া পিটিয়া একটা নূতন ধর্ম বানাইতে পারিতেন, তাহা না করিয়া পুরাতন ধর্ম প্রচার করিলেন। তিনি নিজেকে গুরু বলিয়া চালাইতে পারিতেন, তাহা না করিয়া তিনি প্রাচীন ঋষিদিগকে গুরু বলিয়া মানিলেন।’ অর্থাৎ তৎকালীন হিন্দুসমাজ ‘পর্বতপ্রমাণ জড়ত্বের তলে পড়িয়া প্রতিদিন চেতনা হারাইতেছিল। রামমোহন রায় সেই ভগ্নমন্দির ভাঙিলেন। সকলে বলিল, তিনি হিন্দুধর্মের উপরে আঘাত করিলেন। কিন্তু তিনিই হিন্দুধর্মের জীবন রক্ষা করিলেন।’ ঠিক এই অভিমুখ ধরে এগোলেই আমরা দেখতে পাই, কুসংস্কার, ভ্রান্ত ব্যাখ্যা, গোঁড়ামি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। গোঁড়ামির হাত থেকে উদ্ধার করে ধর্মের প্রকৃত সত্যরূপ তিনি খুঁজতে চাইছিলেন। আর সে জন্য পাথেয় করেছিলেন শাস্ত্রকেই। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলি তিনি যে শুধু নিজে পড়তেন তা নয়, অনেকে যাতে পড়তে পারেন সেই ব্যবস্থাও করছিলেন। এই পাঠের প্রসার যত বাড়ছিল, ততই শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা বা মিথ্যে ব্যাখ্যার স্বরূপগুলি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। রামমোহন ধর্মের বিরোধিতা করেননি, করেছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা। শাস্ত্রের বিবিধ পাঠ উদ্ধার করেই তিনি দেখাতে শুরু করেছিলেন শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা। প্রাচীন শাস্ত্র বহুক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি ছিল উদার। টীকাকারদের ভুল ব্যাখ্যার দরুনই তাঁদের পদে পদে নানা দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়। মৃত্যুঞ্জয়াচার্যের ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করেন রামমোহন, যা ছিল জাতিভেদ এবং ব্রাহ্মণ্যপ্রথার বিরুদ্ধে আক্রমণ। হিন্দু গোষ্ঠীগুলি চাইত না যে ব্রিটিশ সরকার ধর্মীয় অনুশীলনে হাত দিক। রামমোহন নিরন্তর তাঁদের সঙ্গে সংলাপে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এবং হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ যে এই ধরনের অন্ধ সংস্কারকে স্বীকৃতি দেয় না, তা লিখে লিখে প্রচার করেছিলেন যুক্তি সহকারে। সতীদাহ প্রথা এক সময় রদ করা সম্ভব হয়েছল। তবে এখানে লক্ষ্যণীয় রামমোহনের কর্মপদ্ধতি। ধর্মবিশ্বাসকে অস্বীকার করে নয়, বরং যুক্তির সাহায্যে ধর্মের প্রকৃত সত্যকে তুলে আনার কাজটিই তিনি করে গিয়েছিলেন। এই ভাবনার সাক্ষ্য মেলে তাঁর ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার দর্শনেও।
বর্তমান সময়ের নিরিখে তাই রামমোহন রায়কে আমাদের আরও গভীরভাবেই লক্ষ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ যে বলছেন ‘বঙ্গসমাজে বিপ্লবের আগ্নেয় উচ্ছ্বাস সর্বপ্রথমে’ তিনি উৎসারিত করলেন, তা শুধু তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্যই নয়। সেই কর্মপদ্ধতির জন্যেও। অতএব আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তিনি তো স্থিরচিত্তে ভালোমন্দ সমস্ত পর্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি তখনকার অন্ধকার হিন্দুসমাজে আলোক জ্বালাইয়া দিলেন, কিন্তু চিতালোক তো জ্বালান নাই। ইহাই রামমোহন রায়ের প্রধান মহত্ত্ব।’ যখন ধর্ম-সংস্কার-রাজনীতি মিলেমিশে জনজীবন একই সঙ্গে আহত এবং বিভ্রান্ত, তখন আমাদের এই আলোক আর চিতালোকের পার্থক্য বুঝে নেওয়াটাই বোধহয় সবথেকে জরুরি কাজ।