‘আজও মেয়েদের কষ্টের কোনো শেষ নেই, কেননা নানা ছদ্মপোশাকে পুরুষদাপট এখনও মেয়েদের শাসনের চোখেই প্রভুত্বের চোখেই দেখে। ছদ্মই-বা বলি কেন, ঘরের মধ্যে পৌঁছলে অনেকসময়েই সে ছদ্ম তো বেশ প্রকট চেহারাই নেয়।’- মেয়েদের উপর ঘরে বাইরে ঘটে চলা অসম্মানকে চিহ্নিত করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এক নির্যাতিতার হয়ে বিচার চাওয়ার পথ রসদ জোগায় তাঁর সে কথা।
‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে’
১৪ মার্চ নন্দীগ্রামের ঘটনার পর লিখেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর সে কবিতার পঙক্তি সেদিন অনায়াসে বেআব্রু করেছিল ক্ষমতাকে। একই সঙ্গে আন্দোলিত হয়েছিল বাঙালির মন, মনন, বিবেক। রসিদকাগজে লেখা এ-কবিতা বলা যায় একটি সময়ের ক্ষোভ যন্ত্রণার মুখপত্র হয়ে আছে। শুধু কবিতার ভিতর দিয়েই যে তিনি সময়কে স্পর্শ করেছিলেন তিনি, তা নয়। সময়ের দাবিতেই নেমেছিলেন পথেও। আজও বাঙালি ফিরে ফিরে দেখে নাগরিক সমাজের পুরোভাগে তাঁর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা। নীরব সেই হেঁটে যাওয়া যে প্রতিবাদের সরব বয়ান হয়ে উঠতে পারে, বুঝেছিলেন সকলেই।
আরও শুনুন:
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে সবল হোক মেয়েরা, চাইতেন রবীন্দ্রনাথও
অবশ্য সংঘ বা দলের শক্তি থেকে তিনি খানিক দূরত্বই বজায় রেখেছিলেন আজীবন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সত্য থেকে সংঘ হতে পারে/সংঘ তবু পাবে না সত্যকে।’ আজীবন থিতু থেকেছেন সেই বিশ্বাসে। কেননা ক্ষমতার যে স্বরূপ তিনি চিনতেন, তার মন বদল হয়নি। অতএব সংঘ যদি ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে, তবে তার ভাঙন অবধারিত। নিজের দর্শন জানিয়েই কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সংঘ গড়ে উঠবার পর, ক্ষমতা সেখানে কেন্দ্রীভূত হতে থাকবার পর, সেটাকে ভাঙা ছাড়া আর পথ থাকে না। সেই ভাঙা থেকে হয়তো আরেকটা সংঘ হবে, আবার তাকে ভাঙতে হবে, এইভাবে একটা চলার দিশা তৈরি হতে পারে। একটা থেকে আরেকটা ভাঙায় অবস্থানটা ঠিক একরকম থাকে না, থাকবার কথা নয়, তার মধ্যে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া ঘটে যায়, ঘটবার কথা। এইভাবে একটা ক্রমমুক্তির স্বপ্ন দেখতে পারি। আজও তা পারা যায়। অন্তত ও-রকম দেখতে চাই আমি। একে হয়তো বলা যায় অনিঃশেষ, প্রবহমান, এক বামপন্থা।”
আরও শুনুন:
দল বা কোন্দল নয়, ভয় না পাওয়াই রাজনৈতিক
মিছিল ঠিক সংঘ নয়। তা যেন ওই ক্রমমুক্তির স্বপ্ন বা পথের দিকেই এগিয়ে যাওয়া। তা প্রবহমান। আর তাই মিছিলে তিনি ঠেকেছেন বারবার। নন্দীগ্রামের ঘটনার পরবর্তী মিছিলে তাঁর থাকার কথাই বারবার ফিরে আসে। তবে, তিনি বলেছিলেন, ‘দেশজোড়া আন্দোলনের দিক থেকে নন্দীগ্রামের ঘটনা একটা চূড়াস্পর্শ পেয়ে গেছে বলে পথে-নামাটাও হয়ে গেছে অতি-বিজ্ঞাপিত। কিন্তু মিছিলে এ তো আমার প্রথম পথে-নামা নয়। গুজরাটের গণহত্যার পর ত্রাণসংগ্রহের সময়ে, বন্যাবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য ত্রাণসংগ্রহের সময়ে, দিনের পর দিন মিছিলেই তো ছিলাম। চুয়ান্ন বছর আগে বিরাট বহরের যে শিক্ষক-আন্দোলন হয়েছিল- তখনও ছাত্র আমরা – মিছিলে পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল যখন কার্জন পার্ক ঘিরে, তারও মধ্যে তো ছিলাম আমরা। সেই থেকে ধারাবাহিক এত এত কারণে এত এত মিছিলের মধ্যে নন্দীগ্রামটাকেই শুধু আলাদা করে ভাবব কেন?’
আরও শুনুন:
ধর্ষিতার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত? রানিকে ভর্ৎসনা করেই বুঝিয়েছিলেন বিজ্ঞজন
অর্থাৎ প্রতিবাদে শামিল হওয়ার ধারাবাহিকতা থাকে। তা আকস্মিক নয়। বর্তমান সময় যখন নারীর উপর সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তখন আবার নাগরিক সমাজ নেমেছে পথে। মিছিল দেখছে কলকাতা। ভারতবর্ষে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে খুব স্পষ্ট করেই শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছিলেন, ‘স্বাধীনতার পরের পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বড়ো বদলটাই ঘটেছে মেয়েদের জীবনে, মেয়েদের স্বাধীনতার বোধে। আমাদের কৈশোরে সমাজজীবনে মেয়েদের যে-অবস্থান দেখেছি আর আজ যা দেখি, তার বদলের পরিমাণ ভাবলে অভিভূত লাগে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমাদের দেশের মেয়েরা খুব ভালো আছে এখন। চলনেবলনে কাজেকর্মে দায়দায়িত্বে মেয়েদের মুক্ততা যোগ্যতা ক্ষিপ্রতা অনেক বেশি আজ, কিন্তু সমাজ এখনও পৌরুষের প্রতাপ থেকে তাকে অভ্যন্তরীণ মুক্তি দিতে পারেনি। আজও মেয়েদের কষ্টের কোনো শেষ নেই, কেননা নানা ছদ্মপোশাকে পুরুষদাপট এখনও মেয়েদের শাসনের চোখেই প্রভুত্বের চোখেই দেখে। ছদ্মই-বা বলি কেন, ঘরের মধ্যে পৌঁছলে অনেকসময়েই সে ছদ্ম তো বেশ প্রকট চেহারাই নেয়। শিক্ষা যে এ-ব্যাপারে কোনো মুক্তি এনে দেয়, একথা বলবার মতো সময় হয়নি এখনও। ঘরেবাইরে দুটো দিকই সামলে চলার পরেও অধিকাংশ মেয়েই এখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত লাঞ্ছিত অপমানিত। কেবলমাত্র পণপ্রথা বধূনির্যাতন অগ্নিদাহ- এগুলির কথা ভেবেই যে এসব বলছি তা নয়। এসব তো প্রকটভাবেই দেখা যায়। কিন্তু যা প্রকাশ্যত দেখা যায় না, গোপন সেই মানসিক মারগুলো যে কীভাবে কুরে ফেলছে এক-একটা পরিবারকে তার কোনো হিসেব তৈরি করা শক্ত। তাই, ‘লিখে রাখি জলের অক্ষরে/আমার মেয়েরা আজও অবশ ভিক্ষার হাতে পড়ে আছে সব ঘরে ঘরে।’
সত্যি বলতে, এই অবস্থার বদল তো হয়নি আজও। বরং বেড়েছে নারীর উপর অপরাধের ঘটনা। তাই বুঝি সংঘের বাইরে আবারও মানুষ নামছেন পথে। মহানগরী আবার সাক্ষী থাকছে মিছিলের। সে মিছিলে সশরীরে হয়তো নেই শঙ্খবাবু। তবু তাঁর দর্শন আর ঋজু অবস্থান সংকটে দিনে আজও বাঙালিকে পথের খোঁজে প্রাণিতই করে।