বাঙালি নাকি ব্যবসাবিমুখ। বাংলায় শিল্পের দেখাও মেলে না, এই অভিযোগও চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু এককালে যে সাহেবদের টেক্কা দিয়ে রমরমিয়ে ব্যবসা চালাতেন বাঙালিরা, সে কথাও কি মনে রাখা উচিত নয়? এমনকি সেকালের তৈরি এক বাঙালি প্রতিষ্ঠান একশো বছরও পেরিয়ে গিয়েছে গত বছরেই। কোন প্রতিষ্ঠান, জানেন কি?
স্বদেশি আন্দোলন মানেই কিন্তু কেবল বোমা-গুলি-বন্দুকের লড়াই নয়। আবার গান্ধীপন্থীদের অহিংসার পথে প্রতিবাদ করাও নয়। ওই সময়ে পরাধীন ভারতে বিবিধ পন্থায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন একাধিক মানুষ। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা, বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হওয়াও ছিল এই আন্দোলনেরই একটি রূপ। সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেকালে যেসব ভারতীয় জমিয়ে ব্যবসা চালাতেন, তাঁদের অনেকেই সেই কাজকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি ধরন হিসেবেই দেখতেন। আজ ভাবলে হয়তো অবাক লাগবে, কিন্তু সেদিন এই পথে সামিল হয়েছিলেন অনেক বাঙালিও। তাঁদেরই একজন ছিলেন সুরেন্দ্রমোহন বসু। ১৯২০ সালে যিনি জন্ম দিয়েছিলেন আজকের ডাকব্যাক কোম্পানির। গত বছরেই শতবর্ষ পেরিয়েছে তাঁর এই প্রতিষ্ঠান।
আরও শুনুন: ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’, কোথা থেকে এল এই প্রবাদ?
ইংরেজিতে প্রচলিত আছে একটি বাগধারা, ‘লাইক ওয়াটার অফ এ ডাক’স ব্যাক’ (like water off a duck’s back)। হাঁস সারাক্ষণ জলে থাকে, কিন্তু জল থেকে পালক ঝেড়ে ফেললেই তাতে আর জলের লেশমাত্র থাকে না। এই প্রবাদের সূত্র ধরেই ‘ডাকব্যাক’ নামের উৎপত্তি। পরবর্তীকালে কোম্পানির নাম হয় বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ লিমিটেড। কিন্তু ততদিনে ওয়াটারপ্রুফ বা রেনকোটের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে ‘ডাকব্যাক’ নামটিই।
হঠাৎ কেন ওয়াটারপ্রুফের ব্যবসা খোলার কথা ভেবেছিলেন সুরেন্দ্রমোহন বসু? সে কথা জানতে গেলে চোখ রাখতে হবে ইতিহাসের পাতায়। স্বদেশি আন্দোলনের যুগে অনেক উদ্যোগপতিই কেবল লাভের তাগিদে ব্যবসায় নামার কথা ভাবেননি। তাঁদের ব্যবসা শুরু করার তাগিদ জুগিয়েছিল জাতীয়তাবাদী আবেগ। সুরেন্দ্রমোহন নিজে কেবল স্বদেশি ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন এমন নয়, স্বদেশি মত প্রচারের কারণে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। যে যুদ্ধে ভারতের শাসক ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে লড়ছে অনেক ভারতীয় সেনাও। জেলের গরাদের ভেতরে বসে সুরেন্দ্রমোহন জানতে পেরেছিলেন, ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কীভাবে লড়াই করতে হয় এই সৈন্যদের। তাদের না আছে বর্ষাতি, না আছে জলকাদাভরা এলাকায় চলাচল করার উপযোগী গামবুট। আসলে সেই সময় ভারতে বর্ষাতি তৈরি হত না। অন্যান্য কাপড়ের মতো, ওয়াটারপ্রুফও আমদানি করা হত বিদেশ থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই, তার দাম আমজনতার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। আর সাধারণ সেনার সামর্থ্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। এই কথা শোনার পর থেকেই নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে ফেলেন বার্কলে এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র সুরেন্দ্রমোহন বসু।
আরও শুনুন: কলকাতার রসগোল্লার জন্ম এঁর হাতেই, কীভাবে এল এই সাধের মিষ্টি?
পরিকল্পনা মতোই, কারামুক্তির পর ভাই অজিতমোহন, যোগেন্দ্রমোহন ও বিষ্ণুপদকে নিয়ে নিজের বাড়িতেই কারখানা পত্তন করলেন সুরেন্দ্রমোহন। লক্ষ্য, কম দামে ভাল মানের বর্ষাতি তৈরি করা, যাতে দেশের সাধারণ মানুষের নাগালে তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। ওয়াটারপ্রুফ ছাড়াও, সৈন্যদের জন্য স্নো অ্যাঙ্কল বুট, লাইফ জ্যাকেট, সাবমেরিন এসকেপ স্যুট পর্যন্ত তৈরি করত বাঙালির তৈরি এই সংস্থা। আর একশো বছর পেরিয়েও, বিভিন্নরকম ব্যাগ থেকে শুরু করে গামবুট, এয়ার পিলো, সবেতেই নিজের সুনাম বজায় রেখে চলেছে এই সংস্থা। যার জন্ম হয়েছিল পরাধীন ভারতের এক বাঙালির হাত ধরেই।