শিল্পের প্রসঙ্গে শিল্পীকে ক্ষতবিক্ষত করাই এ দেশের অভ্যাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমন কথা বলেই সান্ত্বনা দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু কেন এ কথা উঠে এসেছিল দুই বরেণ্য সাহিত্যিকের মাঝে? শুনে নেওয়া যাক।
কোন শিল্প কার ভালো লাগবে আর কার লাগবে না, তার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই। ভালো লাগলে যেমন তা নিয়ে কেউ দু’কথা বলেন, তেমনই খারাপ লাগলেও তা বলতে পারেন বইকি। সমালোচনা তো দোষের নয়। তবে আক্রমণকে সমালোচনা বলা চলে না। আর এ দেশের শিল্প-সাহিত্যের আলোচনায় সেই সীমারেখাটিই অনেকসময় আবছা হয়ে আসে। নিজের জীবনে বহুবার এ ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই অনুজ সাহিত্যিক যখন এহেন আক্রমণে দিশেহারা, তখন তাঁর পিঠে ভরসার হাতটিও রাখতে পেরেছিলেন তিনিই। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই রবীন্দ্রনাথ জানতেন, এ দেশের সমালোচনার ধারা কীভাবে আক্রমণে পথ হারিয়ে ফেলে। তারাশঙ্করের সাহিত্যিক জীবনের উন্মেষ পর্বেই তাঁকে সেই সত্যের পাঠ দিয়েছিলেন গুরুদেব।
-: আরও শুনুন :-
ভোটপ্রচারে নিন্দেমন্দের শেষ নেই! সভায় কথা বলবেন কোন রীতিতে, শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
তারাশঙ্করের লেখা বড় মোটা দাগের। স্থূল। এমন অভিযোগ ছিল তাঁর সমকালের অনেক লেখক-পাঠকের। সমালোচকেরা কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর লেখা নাকি যাত্রার মতোই চড়া সুরে বাঁধা। বারেবারে এসব কথার ঘা এসে লাগত তারাশঙ্করের গায়ে। তিনিও জন্মসূত্রে বীরভূমের বাসিন্দা, কিন্তু আরেকটু দূরে শান্তিনিকেতন পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁর পা সরত না। তবে একদিন, সাহস করে কবির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন বই। আর কী আশ্চর্য, উত্তরও এসে পৌঁছয়। রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় জানান, “তোমার ‘রাইকমল’ আমার মনোহরণ করেছে।’’ খোদ রবীন্দ্রনাথের থেকে উৎসাহ! যেন অভিভাবকের কাছে নালিশ করার মতোই তারাশঙ্কর লিখলেন, ‘‘রাইকমল সম্পর্কে আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন কি না জানি না। কারণ আমার সমসাময়িকরা আমার লেখাকে বলেন স্থূল।’’ ধৈর্য ধরে সে চিঠিরও উত্তর দিলেন কবি। তারাশঙ্করের ‘ডাইনী’ গল্পটি বিদেশি গল্পের নকল, এমন অভিযোগও শুনতে হয়েছিল লেখককে। তখনও গুরুদেবই তাঁর আশ্রয়। সব হতাশা যেন ধুয়ে যায় কবির কথাতেই। আসে শান্তিনিকেতনে ঘুরে যাওয়ার আহবান। আর সেই শান্ত জগতে বসেই তারাশঙ্করের আক্ষেপের উত্তর দিলেন কবি। বললেন, ‘‘দুঃখ পাবে। পেতে হবে। যত উঠবে তত তোমাকে ক্ষত-বিক্ষত করবে। এ দেশে জন্মানোর ওই এক কঠিন ভাগ্য। আমি নিষ্ঠুর দুঃখ পেয়েছি।’’
-: আরও শুনুন :-
কেবল হিন্দুত্বের কথাই কি বলে বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ?
সত্যিই তো! সমকালে নিজের লেখার সমালোচনা তো বটেই, ব্যঙ্গও কম শোনেননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়ে আঁকা হয়েছে কার্টুন। কটু আক্রমণ শানিয়ে নাটক লিখেছেন একসময়ের প্রিয়জন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। দিনের পর দিন ‘শনিবারের চিঠি’-তে কটাক্ষের তির ছুড়েছেন সজনীকান্ত দাস। কবি নিজেও মনে করতেন, যে কোনও সৃষ্টির প্রতি সমালোচনামুখর হওয়া দোষের কিছু নয়, বরং তা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু সমালোচনাও যে সামাজিক ভদ্রতা গুণের বাইরে নয়, সে কথা বরাবর মনে রেখেছেন তিনি। আর সেই সহজাত ভদ্রতাই বারবার আহত হয়েছে রুচিহীন আক্রমণে। শিল্পের প্রতি অপছন্দে শিল্পীকে টেনে ধুলোয় নামাতে চেয়েছেন সমালোচকদের একাংশ। তারাশঙ্করকে সেই প্রবণতাটিই চিনিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।