বাঙালির পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বাঙালি। ঠিক আগের মতোই আছে! নাকি পয়লা বৈশাখ নেহাত পোশাকি উদযাপনে এসে ঠেকেছে? তা নিয়েই নিজের ভাবনা জানালেন, অভিষেক ঘোষ।
পড়ে শোনালেন: সরোজ দরবার। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক।
ঋষি ধৌম্য বললেন, “হে ঋষিবর, আপনি ত্রিকালজ্ঞ, ভাবীকালে বঙ্গভূমিতে যে বাঙালিগণ আবির্ভূত হবেন, তাঁদের স্বরূপ জানার জন্য আমার হৃদয় উদ্বেল হয়েছে, শাস্ত্রে বলা হয় ‘আত্মানং বিদ্ধি’, শুনেছি ভাবীকালের বাঙালি আত্মবিস্মৃত হবেন, তবে তাঁরা প্রাণধারণ করবেন কীভাবে তা নিয়ে সংশয় হয়। কৃপা করে আমাদের জ্ঞানপিপাসা চরিতার্থ করুন।”
নৈমিষারণ্যে সমবেত কুত্স, অত্রি, বামদেব, ভৃগু-সহ অন্যান্য ঋষিগণ সানন্দে কলরব করে উঠলেন। বৈশম্পায়ন স্মিত হেসে বললেন, ‘ভাবীকালের বাঙালি শিষ্ট ও বিশিষ্ট হবেন। তাঁরা ধুরন্ধর ও বুদ্ধিজীবী বলে খ্যাতকীর্তি হবেন। নিন্দুকরা তাঁদের কাঁকড়া বলে গালমন্দ করবেন বটে, তবে এই বাঙালিগণ ক্ষেত্রবিশেষে বিপ্লবী, রসিক, ভোজনপ্রিয়, প্রেমিক, কবি, সমালোচক ইত্যাদি নানা রূপে অবতীর্ণ হবেন। বাড়িতে বউ এঁদের মেনিমুখো বলে ভর্ৎসনা করবেন বটে, কিন্তু এঁরা প্রকৃত-ই নবীন ও কাঁচা, নবজীবনের আহ্বায়ক।’
ঋষি অঙ্গিরা বললেন, ‘ভাবী বাঙালি নবীনতার সাধক হবেন এ-কথা প্রীতিকর বটে, তবে জনান্তিকে শুনেছি এঁরা কেউ কেউ ‘নস্টালজিয়া’ নামক একপ্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেন যা অল্পে হিতকর, ভূমায় প্রবল হয়ে বিকার উৎপন্ন করে। এ বিষয়ে আমাদের সংশয় নিরসন করুন কৃপা করে।’
বৈশম্পায়ন হেসে বললেন, ‘যথার্থ বলেছ বৎস! ভাবী বাঙালিগণ নবীনকে অঙ্গে ও প্রাচীনকে অন্তরে বহন করবেন। তাঁরা ঠিকঠাক নবীন হতেও চাইবেন না, আবার প্রাচীন বললেও তাঁরা মুখ ভার করবেন। নিজের শিকড়কে তাঁরা প্রাচীন ভেবে অবজ্ঞা করবেন, আবার নবীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও কলহে মেতে আত্মঘোষণায় মগ্ন থাকবেন। প্রত্যেকেই ভাববেন তিনিই সর্বাপেক্ষা আধুনিক। আত্মবিস্মৃতি ও নস্টালজিয়া এই দুই প্রকার রোগ পরস্পরের বিপরীতে থাকে। আত্মবিস্মরণ ঘটলে প্রাচীন অবান্তর, আবার প্রাচীনের আকর্ষণ থাকলে আত্মবিস্মরণ ঘটে না ।কিন্তু কিমাশ্চর্যম্! ভাবীকালের বাঙালি নবীন হওয়ার অভিপ্রায়ে তাঁর মূলকে ভুলতে চাইবেন, আবার মাঝে মাঝে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবেন। এই দ্বিবিধের চাপে তাঁরা হাতে অবশিষ্ট ভগ্ন পেন্সিল নিয়ে বসে থাকবেন বলে নিন্দুকগণ কটাক্ষ করবেন।
এই বাঙালিগণ এককালে নবীন বছরের আরম্ভে আড়ম্বর ঘটাপেটা করতেন। বাঙালিবাবুর পায়রা উড়িয়ে, গানবাজনা করে, মেলায় ঘুরে, নাগরদোলা চড়ে এবং আরও আরও নানাবিধ বিলাসব্যসনে দিনযাপন, বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের ইতিহাস ভাবীকালে চর্চিত হবে। কালে কালে স্রোতস্বিনী গঙ্গায় অগণ্য স্রোতধারা বয়ে যাবে। ক্রমে গঙ্গাও ক্ষীণা হবেন। ক্রমে বঙ্গাব্দ পঞ্জিকায় আবদ্ধ হবে। দোকানে দোকানে হালখাতা হবে বটে, তবে ততদিনে ক্যালেন্ডার, মিষ্টান্ন ইত্যাদির প্রত্যাশা কমে যাবে, দোকানপাট-ও বায়বীয়, অনলাইন। কোলাকুলি ফোনের স্ক্রিনে, শুভেচ্ছা হিংবেংলিশ ভাষায় মেসেজে ও প্রণাম ইমোজিতে সম্পন্ন হবে। এমন দিনে ডিজে বাজিয়ে, জয়রাইড করে, পান ও ভোজনে নববর্ষকে “হ্যাল্লো!” জানিয়ে, বাংলা ভাষার আদ্যশ্রাদ্ধ করে বাঙালি সমকালীন, নবীন ও আধুনিক হবেন। নববর্ষের দিনে বাঙালি নানাবিধ বিচিত্র ধুতি-পাঞ্জাবি ও শাড়িতে শোভিত হয়ে তারকাখচিত হোটেলে ডালভাত, কচু কিংবা মোচার ঘণ্ট খেয়ে সেলফি তুলে ছিন্নপ্রায় তার ও নড়বড়ে শিকড়কে মেরামত করলেন, এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন।
এঁরা বৈশাখের একটি দিন এমন রঙ্গ করে নিজেরা আমোদিত হন, অপরকেও আমোদ দেন। যেন আত্মীয়বাড়ি মিষ্টান্ন দিয়ে সৌজন্য রক্ষা, না করলেই নয় তাই করা, কিছুটা ‘না করলে লোকে কী বলবে’, অথবা, ‘ও করছে তাই আমিও করি’, নতুবা, ‘বিজ্ঞাপনে তো এমনটাই দেখায়, তাই এমন না করলে বুঝি মান থাকে না’ ইত্যাদি ভেবে নববর্ষের উদযাপন। তবে এসবের ব্যতিক্রম যেমন সত্য হবে, তেমনই এককালে যা কর্তব্য, কালান্তরে তা নেহাৎ ঠেকা ও হুজুগে পরিণত হবে, এও সত্য। ভাষা, আবেগ, গান, সংস্কৃতি কোনও নির্দিষ্ট দিনে নয়, নিত্য অন্তরে লালনের বিষয়। ঝকঝকে নবীন হতে গিয়ে যে বাঙালি নোনাধরা দেয়াল টাইলসে ঢাকতে চায় সে আত্মবিস্মৃত, সে-ই আবার শুষ্ক তালপুকুরের বড়াইঘেরা জমিদারির নস্টালজিয়ার সদর্প চর্চায় মশগুল হবে। এতে শিকড় বা মাটির গন্ধটুকু এড়ানো যায়, তবে মহাকাশ-ও ধরা দেয় না, থাকে শুধু ধুলোকাদার ভার, সোনা বলে মনে করা রাংতার রাশি। এতে শুধু আত্মার অবমাননা নয়, সত্তা ও অস্তিত্বের ঘোর সংকট আসে।
বাঙালি নববর্ষের পুণ্যলগ্নে আনন্দযজ্ঞে মাতবে, এ তো সুখের, তবে সংকট এই যে, সর্বঘটে কাঁঠালিকলা হতে গিয়ে আম ও ছালা দুটোই না যায়!’