ছোটবেলার পড়াশুনো শেখার সুযোগটুকু পাননি। সেই তিনিই কালে কালে হয়ে ওঠেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান বিপ্লবী। এই বীরাঙ্গনা শুধু শাসক ইংরেজেরই মাথাব্যথার কারণ ছিলেন না, পুরুষ শাসিত সমাজকেও বুঝিয়ে ছেড়েছিলেন, নারীর ক্ষমতা কতখানি! আসুন, মাতঙ্গিনী হাজরার শহিদ দিবসে তাঁর আশ্চর্য বীরত্বের কাহিনি শুনি।
আজকের ভারতে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে চর্চা হয়। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোও হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ শাসিত সমাজের বাধা ডিঙিয়ে নারী তার ক্ষমতা বুঝে নিচ্ছে। তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতি নারীর সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। কিন্তু, তাঁর আমলে সমাজ ছিল আলাদা। সেই আঠেরোশো শতকের নারীকে থাকতে হত পর্দার আড়ালে। সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র আর হেসেলের কারবারি হওয়াই ছিল তাদের নিয়তি। স্বামীর মৃত্যুতে সতী হতে হত। অথবা বেনারস কী বৃন্দাবনের বাসিন্দা হতেন ওরা। এমন রীতিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন তিনি। ইংরেজ শাসকের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নারীর সক্ষমতা কতখানি। জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও লিখতে পারেন অগ্নিযুগের ইতিহাস।
পরাধিন ভারতে বিপ্লবের আঁতুরঘর ছিল মেদিনীপুর। এই জেলারই এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান মাতঙ্গিনী হাজরা। জন্ম ১৮৬৯ সালে। তমলুকের অদূরে আলিনান নামের একটি ছোটো গ্রামে জন্ম হয় মাতঙ্গিনীর। দারিদ্রের কারণে প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তিনিই পরবর্তীকালে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবেন ইংরেজ পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হবেন। আর শহিদ গান্ধীবুড়ির কথা কেউ, কোনোদিন ভুলতে পারবে না!
আরও শুনুন: অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ‘বঙ্গমাতা’, স্বদেশিরা আপন করে নিলেন ‘ভারতমাতা’ রূপে
গান্ধীবাদী মাতঙ্গিনী ১৯০৫ সাল থেকে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩২-এর আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। লবণ আইন অমান্য করে গ্রেফতার হন। হয়তো নারী বলেই দ্রুত মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু ফের কর মকুবের দাবিতে প্রতিবাদ আন্দোলন যোগ দেন মাতঙ্গিনী। এবং আবারও কারারুদ্ধ হন। এই পর্বে ছ-মাস বন্দি ছিলেন জেলে। এবারে কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ অনুভব করে মাতঙ্গিনী নেহাত ‘অবলা’ নারী না। অতএব, পুলিশের কড়া নজরে চলে আসেন মাতঙ্গিনী হাজরা। এদিকে মুক্তিলাভের পর আরও বেশি করে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন ‘গান্ধীবুড়ি’। জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য হন। নিজের হাতে চরকা কেটে খাদির কাপড় বানাতেও শুরু করেন। ১৯৩৩ সাল। সেবার শ্রীরামপুরে মহকুমা কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী। পুলিশ সেই অধিবেশন ভন্ডুলের চেষ্টা করে। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন মাতঙ্গিনী হাজরা।
সেটা ১৯৪২ সাল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল দেশ। জেলার কংগ্রেস সদস্যেরা ঠিক করেন, জেলার সব থানা ও সরকারি কার্যালয় দখল করবেন। উদ্দেশ্য ছিল, জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের শিকড় তুলে ফেলা ও স্বাধীন মেদিনীপুর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এখানে না বললেই নয়, যে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের মেদিনীপুর জেলার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, নারীদের আন্দোলনে যোগদান। সেই কারণেই মাতঙ্গিনীর মতো বিপ্লবীর জন্ম হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ছয় হাজার মহিলা স্বেচ্ছাসেবক তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে মিছিল শুরু করে। নেতৃত্ব ছিলেন ৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরা। শহরের উপকণ্ঠে মিছিল পৌঁছলে ব্রিটিশের পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। যাতে করে বিপ্লবীদের জনসমাবেশ ভেঙে দেওয়া যায়। যা হতে দেননি গান্ধীবুড়ি। পুলিশের চোখ রাঙানি আগ্রাহ্য করে আগ্রসর হন বৃদ্ধা নেত্রী। ফলে মাতঙ্গিনীকে লক্ষ করে গর্জে ওঠে ইংরেজ পুলিশের বন্দুক। গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তবু, গুরুতর আহত মাতঙ্গিনী এগিয়ে চলেন। এবং প্রকৃতি নেত্রীর মতোই ইংরেজ পুলিশের কাছে আবেদন করেন, মিছিলের ওপরে যেন গুলি চালান না হয়।
আরও শুনুন: ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল, চক্রান্তের স্বীকার হয়েছিলেন দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার Kadambini Ganguly!
মোট তিনটি গুলি লাগে মাতঙ্গিনী হাজরার। গুলি লাগে তাঁর কপালে ও দুই হাতে। তবুও, প্রাণ থাকতে জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা ধরা ছিল মাতঙ্গিনীর হাতেই। বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে শহিদ হয়েছিলেন এই বীরাঙ্গনা বিপ্লবী। মৃত্যুর পরে জন্ম হয়েছিল আরেক মাতঙ্গিনী হাজরার! সেই জন্ম ছিল অনুপ্রেরণার। তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনি জেনে বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বাংলা তথা ভারতের অসংখ্য বিপ্লবী।
যদিও ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ নিয়ে সেকালে তত চর্চা হত না, বিষয়টাকে খায় না মাথায় দেয়, হলফ করে বলা যায়, তা জানতেন না স্বয়ং মাতঙ্গিনীও। তথাপি, ইংরেজ সরকারের পাশপাশি পুরুষ শাসিত সমাজকেও শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নারীর ক্ষমতা কতখানি!