নাটকে এমন বাস্তবতার ছবি তুলে ধরেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, যা রঙ্গালয়ে টেনে এনেছিল খোদ বিদ্যাসাগরকে। সেই নাটক দেখেই রাগে, ক্ষোভে জুতো ছুড়ে মারেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু কেন? শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
প্রথম নাটকেই সারা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নাটক দিয়েই পথচলা শুরু করেছিল বাংলার প্রথম পেশাদার থিয়েটার। এমনকি প্রায় একশো বছর পরেও সেই নাটকেরই দ্বারস্থ হয়েছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। অথচ সেই নাটক ‘নীলদর্পণ’ যিনি লিখেছিলেন, সেই দীনবন্ধু মিত্র যেন রয়ে গিয়েছেন বাঙালির বিস্মৃতির আড়ালেই।
আরও শুনুন: ‘পথের পাঁচালী’ ছাপতে নারাজ সকলে, বিভূতিভূষণের জন্যই শুরু হয়েছিল এই নতুন পত্রিকা
ডাকবিভাগের সরকারি চাকরির সুবাদে সারা বাংলাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিলেন দীনবন্ধু। আর সেখান থেকেই তিনি তুলে নিয়েছিলেন নাটক লেখার রসদ। গ্রামেগঞ্জে ঘুরতে ঘুরতেই নীলকর সাহেবদের দৌরাত্ম্যের কথা জানতে পারেন দীনবন্ধু। তাঁর মনে হয়, গ্রামবাংলার সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থেই এই সমস্যা বাইরের জগৎকে জানানো উচিত তাঁর। সে কথা ভেবেই তিনি কলম তুলে নিয়েছিলেন। লেখা হয়েছিল ‘নীলদর্পণ’। নীলকরদের অত্যাচারে কোথাও ধর্ষিতা হচ্ছে কৃষক মেয়ে, কোথাও জমি হারিয়ে অনাহারে মরছে কৃষক, আবার কোথাও প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছারখার হয়ে যাচ্ছে শিক্ষিত সচ্ছল পরিবারও- এই সবকিছুই জীবন্ত ছবি পেয়েছিল দীনবন্ধুর নাটকে। কিন্তু সরকারি আমলার কলমে এহেন ইংরেজবিরোধী লেখাকে কি ইংরেজ সরকার কখনও মেনে নিতে পারে? দীনবন্ধু ভালোই জানতেন, ‘নীলদর্পণ’-এর লেখক পরিচিতি প্রকাশিত হলে তাঁর সমূহ ক্ষতি হতে পারে। তাই ১৮৬০ সালে যখন এ বই প্রকাশ পেল ঢাকা থেকে, সেখানে লেখকের নামের জায়গায় লেখা হল- ‘নীলকর-বিষধর-দংশন কাতর-প্রজানিকর / ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ পথিকেনাভিপ্রণীতং’। দীনবন্ধু রেহাই পেলেও, এ বইয়ের সঙ্গে জড়িত সবার সে সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দিয়ে ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়েছিলেন রেভারেন্ড জেমস লং। তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন ইংলিশম্যান পত্রিকার সম্পাদক, এক মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয় পাদ্রি লং-এর। গোটা সমাজ জুড়ে দীনবন্ধুর এই নাটক যে আলোড়ন তুলেছিল, তাতেই প্রথম নীলকরদের অত্যাচারের কথা ছড়িয়ে পড়ে।
আরও শুনুন: পুজোর শহর মাতল তাঁর অসম্ভবের ছন্দে, বাঙালিকে আজও ভাবায় সুকুমার রায়
১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর, অর্থাৎ নাটক প্রকাশের প্রায় বারো বছর পরে, এই নাটক দিয়েই পথচলা শুরু করেছিল সাধারণ রঙ্গালয়। সেদিনের অভিনয় দেখতে হাজির হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও। সেখানে অত্যাচারী নীলকর সাহেব উডের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন খ্যাতনামা অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। একে দীনবন্ধুর জীবন্ত বর্ণনা, তার উপর অর্ধেন্দুশেখরের বাস্তব অভিনয়। যেখানে কৃষকরমণীর উপর অত্যাচারে মত্ত উড সাহেব, সেই দৃশ্যে প্রচণ্ড রাগে নিজের পা থেকে জুতো খুলে অভিনেতার দিকে ছুড়ে মারেন বিদ্যাসাগর। এ তাঁর বড় পুরস্কার, এই বলে সেই জুতো কুড়িয়ে নিয়েছিলেন অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর। সত্যি বলতে, কেবল অভিনেতাই নন, দর্শককে নাটকের সঙ্গে এমন একাত্ম করতে পারা কি কোনও নাট্যকারের কাছেও বড় পুরস্কার নয়? বাঙালির স্মৃতিতে তিনি যদি বা খানিক আড়ালেও পড়ে যান, নীলদর্পণের জন্যই ইতিহাসে ঠাঁই পেয়ে গিয়েছেন দীনবন্ধু মিত্র।