বৈশাখের প্রথম দিন। পঞ্জিকা মতে এইদিনে আলাদা করে গণেশ পুজোর কোনও নিয়ম নেই। লক্ষ্মী পুজোরও নয়। অথচ এদিন সকাল সকাল লক্ষ্মী গণেশের মূর্তি নিয়ে মন্দিরে ভিড় জমান বাঙালি ব্যবসায়ীরা। অনেকের বাড়িতে বা দোকানেও এইদিন লক্ষ্মী-গণেশ পুজোর রেওয়াজ আছে। অনেকে আবার এইদিন অবশ্যই নিমপাতা খান। ভৌগোলিক অঞ্চল ভেদে এমনই কতশত নিয়মের বেড়ায় বাঁধা রয়েছে ‘পয়লা বৈশাখ’। যেগুলোর নেপথ্যে, তেমন কোনও শাস্ত্রীয় বাখ্যা না থাকলেও, মিশে আছে মানুষের মনের বিশ্বাস। সে-কথাই মনে করিয়ে দিলেন শুভদীপ রায়।
পয়লা বৈশাখ। হয়তো রাতজাগা উদযাপন নেই। কেক কাটা, বাজি পোড়ানো এইসবও নেই। অথচ এই দিনটাকে আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতো ভাবতে পারেন না অধিকাংশ বাঙ্গালিই। কারও বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না, ছোটদের জন্য নতুন জামা, সব মিলিয়ে বাঙালির আবেগের উৎসব হিসেবে ধরা দেয় বাংলা বছরের প্রথম দিন।
আরও শুনুন: হিন্দুর সন্ন্যাসের উপবাসের পাশেই মুসলমানের রমজান, দুই ধর্মের অপূর্ব সাদৃশ্য চৈত্রের বাংলায়
অথচ পঞ্জিকায় এর আলাদা কোনও গুরুত্ব নেই। সেখানে অক্ষয় তৃতীয়াকে যেমন স্পষ্ট ভাবে ‘শুভ তিথি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তেমন কিছুই জোটে না পয়লা বৈশাখের জন্য। তাহলে, এই দিনেই কেন হাজার হাজার বাঙালি ভিড় জমান মন্দিরে? কেনই বা ঘটা করে লক্ষ্মী গণেশের পুজোর আয়োজন করেন ব্যবসায়ীরা? নেপথ্যে রয়েছে স্রেফ মনের বিশ্বাস। কথায় আছে, যার শেষ ভালো তার সব ভালো। কিন্তু তাই বলে কি শুরুর দিনটা হেলায় নষ্ট করা যায়! বরং অনেকেই মনে করেন বছরের প্রথম দিনটা যেভাবে কাটানো হবে, গোটা বছরটাই ঠিক তেমন কাটবে। আর কোনও কিছু শুরুর ক্ষেত্রে ঈশ্বরের স্মরণ করাটা অনেকেরই চিরন্তন অভ্যাস। সেই অভ্যাসের খুঁটিতে ভর দিয়েই বাংলা বছরের প্রথম দিনে মন্দিরে ছোটে মানুষ। আবার বাঙালি ব্যবসায়ীদের কাছে এই দিন নতুন হিসাব শুরুর দিন। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে, এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সারা বছরের খাজনা মিটিয়ে দেওয়ার আনন্দ। বলা বাহুল্য, সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত বাংলা ক্যালেন্ডারও এই ধারাকে অনুসরণ করেই বানানো। তবে সেই খাজনা দেওয়ার দিন আর নেই। তার চলতি রূপ হয়েছে হালখাতা। যে খাতায় বাঙালি ব্যবসায়ীরা এইদিনেই শুরু করেন নতুন বছরের হিসেব। পুরনো বছরে যা কিছু পাওনা বাকি ছিল, তার সবটা মিটিয়ে নতুন শুরু। তাই এইদিনে লক্ষ্মী-গণেশ পুজো করাটা খুবই স্বাভাবিক। সে পঞ্জিকায় এই দিনের আলাদা কোনও গুরুত্ব থাকুক বা নাই থাকুক।
আরও শুনুন: বইমেলায় নজর কাড়ছে সুলেখার ‘ফিরিঙ্গী কালি’, কেন এমন নামকরণ জানেন?
এবার আসা যাক নিয়মের প্রসঙ্গে। বাংলা বছরের শেষ দিনে পালিত হয় গাজন উৎসব। তার আগে একমাস শিবগোত্রে সন্ন্যাস নিয়ে ব্রত পালন করেন হিন্দুরা। সে ব্রতের নিয়ম বেশ কঠিন। তবে তার চেয়েও কঠিন বা বীভৎস গাজনের দিন পালন করা নিয়মগুলো। গায়ে লোহার বঁড়শি বেঁধা কিংবা কাঁটাঝোপে ঝাঁপ দেওয়া, একাধিক অদ্ভুত নিয়ম পালন করেন ব্রতীরা। তবে এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পয়লা বৈশাখের সকালে পালন করা এক নিয়ম। অনেকে এই দিন গাজনের মন্দির থেকে নিয়ে আসা কাঁটা সামান্য উত্তপ্ত করে বাড়ির সকলের গায়ে ছ্যাঁকা দেন। বিশ্বাস, সারাবছর সবরকম বিপদ থেকে মুক্ত রাখবে এই কাঁটার ছ্যাঁকা। অনেকে আবার এই দিন নিমপাতাও খান। সেসবের নেপথ্যেও বিশেষ কোনও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নেই। মনের বিশ্বাসেই এইসব যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছেন অনেকে। তবে নিয়মকানুনের উপরের গিয়েও বলা যায়, এই দিন আসলে বাঙালির উদযাপনের দিন। আনন্দের দিন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়েই তাই আরও একটা নতুন বছর শুরু করেন বাংলার সাধারণ মানুষ।