একদিকে পবিত্র রমজান মাস। অন্যদিকে গাজন। দুই আলাদা সম্প্রদায়ের প্রধান দুই ব্রত। অথচ নিয়মের দিক দিয়ে তাদের কী অদ্ভুত মেলবন্ধন। উভয় ক্ষেত্রেই ব্রতীদের সারাদিন উপোস, তারপর সূর্য অস্ত গেলে ফল জল। এমনকি দুটি ব্রত পালিতও হয় একই মাসে। বাংলা বছরের শেষ মাস হিসেবে, চৈত্র যেন এভাবেই মিলিয়ে দিয়ে যায় হাজার হাজার বাঙালিকে। আসুন শুনে নিই।
কথায় আছে, যার শেষ ভালো তার সব ভালো। সেকথা যেন বাংলা ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও ধ্রুবসত্য। অন্তত চৈত্রের দিকে দেখলে তেমনটা মনে হতে বাধ্য। একইসঙ্গে কী সুন্দর সহাবস্থান করছে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্রতের দিনগুলো। একদিকে যেমন পরিবারের মঙ্গল কামনায় রোজা রাখছেন এক মুসলিম মহিলা। অন্যদিকে তেমনই সারাদিন উপোস করে শিবের ব্রত পালন করছেন এক হিন্দু পিতা। নিয়ম প্রায় এক। উদ্দেশ্যও এক। শুধু ধর্মীয় পরিচয় আলাদা।
আরও শুনুন: ভাষাকে ভালবেসেই শহিদ-তর্পণ, একুশে স্মরণ তাঁদের ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন যাঁরা
যে বাঙালি রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা পালন করে তার কাছে অবশ্য এ কোনও নতুন ব্যাপার নয়। এখানে ছেলের জ্বর হলে অসহায় মা পীরের দরবারে হত্যে দেন। আবার নতুন গাড়ি কিনে কালী মন্দিরে পুজো দিতে আসেন মুসলিম যুবক। তেমনই অদ্ভুত ভাবে সহাবস্থান করে এই দুই ব্রতও। সঠিকভাবে ধরতে গেলে অবশ্য গোটা চৈত্র মাস জুড়েই যে সহাবস্থান দেখা যায় তা নয়। বরং বৈশাখের শুরু কটা দিনও রোজার মেয়াদ ফুরোয় না। তবু চৈত্র মাসের অধিকাংশ দিনই এই দুই ব্রতকে প্রায় এক সুতোয় বেঁধে রাখে। গাজনের নিয়ম অনুযায়ী, চৈত্র সংক্রান্তির আগে একমাস ধরে কঠোর নিয়ম পালন করতে হয় ব্রতীদের। সারাদিনই প্রায় উপবাস থেকে সূর্যাস্তের পর ফল-জল। আবার ব্রতের দিন এগিয়ে এলে সেই নিয়মের কঠোরতা আরও বাড়ে। আবার রমজান মাসে মুসলিমদেরও একইভাবে রোজা রাখতে হয়। তাঁরাও সারাদিন কিচ্ছুটি দাঁতে কাটেন না। সন্ধ্যায় নামাজ পড়ে ইফতার করতে বসেন। মানে সূর্য মাথার উপর থাকলে উপোস করেই কাটাতে হয়। আর নিয়ম একদিনের নয়। যুগ যুগ ধরে চৈত্র মাসেই গাজন আর রমজান পালন করেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। বলা বাহুল্য, সকলের উদ্দেশ্যও এক। সকলেই চান ব্রতের পুণ্যে তাঁদের পরিবার যেন সুস্থ থাকে, সমাজের সর্বস্তরেই যেন ছড়িয়ে পড়ে মঙ্গল আলোক।
আরও শুনুন: দেশ ছাড়ার ভাবনা নেতাজির, পাউরুটির মধ্যেই গোপন খবর পৌঁছে দিতেন সাবিত্রী দেবী
কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এই সম্প্রীতির কথা ভুলতে বাধ্য করছে। দেশজুড়ে ধর্মের নামে চলা রাজনীতির চাপে হারিয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব। ধর্ম আর দেশ যেন সমানুপাতিক হয়ে উঠেছে। নিজের ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস না থাকা যেন দেশদ্রোহিতার সমান, এমন কথাকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে কেউ কেউ। বারবার এ প্রসঙ্গে সোচ্চার হচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন। অথচ ফল মিলছে কোথায়? ধর্মের নামে সেই তো অন্ধ হচ্ছে মানুষ। তবে যতই হিংসা থাকুক, বাঙালির কাছে হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধন চিরন্তন। এখানে হিন্দুরা যেমন ঈদের সিমুই খায়। মুসলিমরাও তেমন দুর্গাপুজোয় নতুন জামা কেনে। আবার বছর শেষে ধর্মীয় নিয়মেও যেন একাকার হয় দুই সম্প্রদায়।