‘ম’ মানে মরবে না মাতৃভাষা… ১৯৫২ সালের পর সে কথা ফের প্রমাণ হয়েছিল ১৯৬১ সালে। প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কিছু বাঙালিই। নেহাতই সাধারণ মানুষ তাঁরা, কিন্তু তাঁদের বুকে ছিল অসাধারণ সাহস। যার জন্য বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়তেও তাঁদের বাধেনি। নিজেদের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, মাতৃভাষার অপমান রুখতে প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের অনেকে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক বাংলা ভাষার আরেক আন্দোলনের কাহিনি।
যে মাতৃভাষার সঙ্গে পুঁজির যোগ কম, আজকের দুনিয়া তাকে ক্রমশ বাতিলের খাতায় ঠেলতে চায়। কিন্তু যে ভাষার সঙ্গে জুড়ে আছে দু-দুটো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, তাকে মুছে ফেলা কি অতই সহজ? হ্যাঁ, বাংলা ভাষার ইতিহাসে লেগে রয়েছে দুটি ভাষা আন্দোলনের রক্তের দাগ। নিজেদের কোনও স্বার্থে নয়, কোনও ব্যক্তিগত প্রাপ্তির তাগিদে নয়, শুধুমাত্র ভাষাকে ভালবেসে, ভাষার উপর আক্রমণ রুখতে প্রাণ দিয়েছিলেন একাধিক বাঙালি। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তঝরা স্মৃতি ফিকে হওয়ার আগেই ফের রক্তের দাগ পড়েছিল বাংলা ভাষায়। অসমের বরাক উপত্যকায় ভাষার জন্য পথে নেমে সেই পথেই প্রাণ দিয়েছিলেন ১১ জন ভাষা শহিদ। সেদিন যেমন তাঁদের সঙ্গেই পথে নেমেছিলেন আরও অসংখ্য মানুষ, তেমনই তাঁদের মৃত্যুর পরও প্রতিবাদ চালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের সহযোদ্ধারা। আর এই লড়াইয়ের জেরেই নিজেদের মাতৃভাষা বাংলাকে তার প্রাপ্য অধিকার এনে দিয়েছিলেন তাঁরা।
আরও শুনুন: অনন্য স্বীকৃতি, আফ্রিকার এক দেশেও সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা
১৯৬০ সালের গোড়া থেকেই অসমিয়া ভাষাকে সে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছিল অসম সরকার। অথচ সে রাজ্যে বাঙালির সংখ্যা কম ছিল না। ফলে এহেন প্রস্তাবে ক্ষোভ বাড়ছিল। এদিকে সরকারের তরফে প্রশ্রয় পেয়ে বাঙালিদের উপর বারে বারে আক্রমণ শানাচ্ছিল অসমিয়াদের একাংশ। দেশভাগের পর পরই যে বাঙাল খেদাও কর্মসূচির সূচনা, তা আরও জোর পেয়েছিল এই সুযোগে। এই আক্রমণে ইতিমধ্যেই প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যান। বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যান আরও প্রায় লাখখানেক বাঙালি। এরই মধ্যে ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা অসমিয়াকে অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব দেন, যা ২৪ অক্টোবর বিধানসভায় গৃহীতও হয়ে যায়। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করলেও লাভ হয়নি। কিন্তু তাতে বিরোধী স্বরকে একেবারে দমিয়ে দেওয়াও যায়নি। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলেন বাঙালিরা। এই সংগঠনের তরফে লাগাতার প্রচার ও আন্দোলন জারি ছিল। ঘোষণা করা হয়েছিল, ১৩ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া না হলে ১৯ মে ব্যাপক হরতাল করা হবে।
আরও শুনুন: মুক্তিযুদ্ধের দরুন পাওয়া গেল ORS, বিশ শতকের সেরা আবিষ্কারের কৃতিত্ব তিন বাঙালির
বাঙালিদের এই হরতাল দমন করতে বরাক উপত্যকা জুড়ে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে অসম সরকার। শুরু হয় একের পর এক গ্রেপ্তার। নজন সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশের একটি ট্রাক, যা দেখে উত্তেজনা ছড়ায় আরও। একটি ট্রাকে আগুন জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। আর এরপরেই গুলি চালাতে শুরু করে সেনা। শুরু হয় লাঠিচার্জ। সতেরো রাউন্ড গুলি চলেছিল সেদিন। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন, দুজন পরে মারা যান। মৃতদের মধ্যে ছিল ষোল বছরের এক কিশোরীও। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই আন্দোলনে পা মিলিয়েছিল সে। আর সেদিনই কমলার প্রাণ কেড়ে নেয় অসম রাইফেলসের গুলি। পরে বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহিদ হিসেবে স্বীকৃতি পান কমলা ভট্টাচার্য।
সেদিন আর যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন- কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সুকোমল পুরকায়স্থ। বরাকের ভাষা আন্দোলনের এই শহিদদের স্মরণে সেখানকার কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী লিখেছিলেন-
“দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, ‘এই যে ঈশান কোণ–
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন।’
শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা–
‘বাংলা আমার মাতৃভাষা, ঈশান বাংলা মা।”
সান্ত্বনা এটুকুই, যে, শহিদের রক্ত ব্যর্থ হয়নি। এরপর বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল অসম সরকার। এই ভাষা শহিদেরা সেদিন যে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার জন্য তাঁদের কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই।