“সিউড়িতে হরেরাম মৈত্তির/ পাঁজি দেখে সতেরোই চৈত্তির।/ বলে, আজ যেতে হবে মথুরায়।”- ছড়ার ছন্দে এই খবর দিচ্ছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসলে, এককালে বাঙালির বাড়ির পুজোআচ্চা থেকে শুরু করে বাড়ির বাইরে যাত্রা, সবকিছুই চলত পাঁজির নিদান মেনে। এখনও, বাঙালি যতই আধুনিক হয়ে উঠুক না কেন, তার জীবন অনেকখানিই ঘিরে আছে এই লালচে মলাটের বইটি। পারিবারিক থেকে সামাজিক উৎসব, পাঁজি দেখা ছাড়া গতি নেই বাঙালির। কিন্তু কেন চালু হয়েছিল এহেন বই, আর কবে থেকেই বা তার যাত্রা শুরু? খোঁজ করলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়। ছবি: শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নতুন বছর শুরু মানেই আশায় আশায় বুক বাঁধে মানুষ। কী আছে নতুন বছরের ঝুলিতে, ভাল কিছু ঘটতে চলেছে এই বছরে, নাকি সামনে আছে কোনও বিপদের আশঙ্কা- সব মিলিয়ে বছরটা কেমন কাটবে, তা জানার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করা আমবাঙালি। আর সেই খবরই আসে খোদ শিবঠাকুরের মুখ থেকে। আজ্ঞে হ্যাঁ, নববর্ষের ভোরেই কৈলাসে নতুন বছরের হিসাবকিতাব নিয়ে বসেন খোদ শিব আর পার্বতী। ত্রিকালজ্ঞ স্বামী থাকতে আর চিন্তা কী, জগৎসংসারের কথা জেনে নিতে হবে না? তাই গাজন শেষের পর স্বামীকে একান্ত অবসরে পেতেই প্রশ্নের মালা নিয়ে হাজির পার্বতী। শিবও তো আর পাঁচজন বাঙালি স্বামীর মতো নন যে স্ত্রীর সামনে মুখে কুলুপ আঁটবেন! বউয়ের সব প্রশ্নের সামনেই তিনি হাজিরজবাব। জগতের উৎপত্তি হল কেমন করে, সবার আগে কার জন্ম, সেই কোন প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে পার্বতীর প্রশ্ন গড়ায় আগামী ভবিষ্যতের দিকে-
‘বর্ষে বর্ষে কেন হয় নূতন নূতন।
কী নিমিত্ত হয় কহ রাজা পাত্রগণ।।
নূতন পঞ্জিকা নাম হয় কী কারণ।
কী হেতু করিবে নব পঞ্জিকা শ্রবণ।’
আরও শুনুন: হিন্দুর সন্ন্যাসের উপবাসের পাশেই মুসলমানের রমজান, দুই ধর্মের অপূর্ব সাদৃশ্য চৈত্রের বাংলায়
আর অমনি দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে পড়েন শিবের দুই চেলা- নন্দী আর ভৃঙ্গি। ‘ভব কন ভবানীকে কহি বিবরণ। বৎসরের ফলাফল করহ শ্রবণ।’- আর সেই বিবরণ শুনতেই উদগ্রীব দুজনে। বাংলাদেশের গ্রহবিপ্রদের এ কথা জানানোর ভার তো তাঁদের উপরেই। সে কথা জেনে তবেই না গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে লোকের কাছে নববর্ষের ফলাফলের কথা পৌঁছে দেবেন বামুনঠাকুরেরা। কিন্তু মুশকিল হল, শিব যতই খোলসা করে বর্ষপঞ্জির কথা জানিয়ে দিন না কেন, এই পুরোহিত-ব্রাহ্মণেরা সেসব কথা সাঁটে লিখে রাখতেন নিজের কাছে। বছরের গোড়ায় গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বার, তিথি ও করণ ক্রিয়ার খবর দিতেন তাঁরা, পরে আবার মধ্যে মধ্যে গিয়ে সেসব ঝালাই করে আসতেন। লিখিত কোনও পাঁজি তখনও ছিল না। আর তার জেরে যে সমস্যা দেখা দিত, তা হল তিথি নক্ষত্রের হিসেবে নানারকম গোলমাল। দেখা যেত, এক এলাকার ব্রাহ্মণসমাজ দিন-ক্ষণ-লগ্ন-তিথির যে সূক্ষ্ম হিসেব করেছেন, তার থেকে সামান্য আলাদা হয়ে গিয়েছে অন্য কোনও ব্রাহ্মণসমাজের হিসেব। সাধারণ মানুষ তাহলে করে কী? অষ্টাদশ শতকে এই সমস্যা মেটাতে প্রথমবার উদ্যোগ নিলেন নবদ্বীপ সমাজের মুখপাত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তিনি হিসেবনিকেশে একটি সমতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, তা না হলে তো হিন্দুর ধর্মকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। জানা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে রামচন্দ্র বিদ্যানিধি-সহ আরও পণ্ডিতেরা এক পঞ্জিকার সংকলন করেছিলেন। নদিয়া অঞ্চলে স্মার্ত রঘুনন্দনের প্রেরণায় বাংলা পঞ্জিকা প্রচলিত হয়েছিল। তবে হাতে লেখা পুথির সংখ্যা সীমিত, তাই বিশিষ্ট জনদের মধ্যেই এইসব পঞ্জিকা বিতরণ করা হত। কিন্তু পরের শতকেই এই সমস্যার একটা পাকাপাকিরকম সমাধান পাওয়া গেল। কারণ উনিশ শতকেই বাংলায় স্থাপিত হল মুদ্রণযন্ত্র। আর সেখান থেকে ছাপা হতে শুরু করল পঞ্জিকা। প্রথম দিকে মুদ্রিত পঞ্জিকার নামপত্রে উল্লেখ থাকত ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে সঙ্কলিত’।
আরও শুনুন: মুঘল সম্রাট আকবর নাকি গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্ক, বঙ্গাব্দের প্রবর্তক আসলে কে?
পঞ্জিকা শব্দটি প্রাচীন। পঞ্চ অবয়বের সমাহার অর্থে পঞ্জিকা বা পঞ্চাঙ্গ বোঝাত। শাস্ত্র অনুমোদিত পাঁচটি অবয়ব হল, বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ আর করণ নির্ণয়। বাঙালির রোজকার জীবনে, আচার-বিচার, পূজা-পার্বণ, শুভকাজ থেকে বাড়ির বাইরে যাত্রা, সবকিছুই এককালে নির্ধারণ করত এই পাঁচটি বিষয়। তাই বাঙালির আটপৌরে জীবনে ধর্মচালিত কর্মপ্রণালীর গাইডবুক হয়ে উঠেছিল পঞ্জিকা। সেই কারণেই, বাঙালির বর্ষবরণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে গিয়েছিল এই বই। পয়লা বৈশাখে নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জিকার আগমন ছিল অপরিহার্য। পঞ্জিকার তিথিনক্ষত্রের হিসেবই নয় কেবল, পঞ্জিকার পাতায় অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপনের প্রতিও মানুষের আকর্ষণ কম ছিল না। টিভি কিংবা ইন্টারনেটের পাল্লার দূরে থাকা অল্প বিনোদনের সেই দুনিয়ায় মানুষকে একরকমভাবে বিনোদন জুগিয়ে যেত পঞ্জিকার সচিত্র গুপ্তকথা, কবিরাজি সালসা, প্রসাধনী, জাদুবিদ্যা কিংবা কামেশ্বর বটিকার মতো যৌন ওষুধের বিজ্ঞাপন। শুধু তাই নয়, পালপার্বণের তালিকার পাশেই জায়গা পেত আদালতের নানা পেশাদারি তালিকা, রেলের টাইমটেবিল ও ভাড়ার পঞ্জি, কিংবা পোস্ট অফিসের নিতান্ত জাগতিক কাজকর্মের সারণিও। আর সেই কারণেই কোথাও গিয়ে ধর্মকেও ছাপিয়ে উঠেছিল পাঁজির প্রয়োজনীয়তা। তাই দেখা যায়, ব্রাহ্ম ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও মহারাষ্ট্র থেকে জ্ঞানদানন্দিনীকে পাঁজি পাঠাতে লিখছেন রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকার খোঁজ মেলে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুরে ছাপা সেই পত্রিকার সংকলক রামহরি। জোড়াসাঁকোর দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ তাঁর পাঁজির নিচে জানান, ‘অক্লেসে ক্লেস নাই/ পঞ্জিকা সকলের ঠাঁই/ দেখিবেন যখন হবে মনে।’ ১৮৫৬ সালে স্যান্ডারস কোম্পানি থেকে বেরোয় হলধর বিদ্যানিধির পঞ্জিকা, যার ছবি ও বর্ডার বিলেত থেকে আনা হয়েছিল। আর ১৮৮৮ সালে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্যই ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা প্রকাশ করল পি এম বাকচি, যা এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এ ছাড়া ছিল মোহম্মদ রেজাউদ্দীন আহমেদ সঙ্কলিত বৃহৎ মহম্মদীয় পঞ্জিকা। এই আধুনিক যুগেও বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা, কিংবা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার নাম শোনেনি, এমন বাঙালি বিরল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো পাঁজির প্রয়োজনীয়তা কমেছে, কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। বাঙালি জীবনের অঙ্গ হয়েই বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে পঞ্জিকা, আর বাঙালির একটুকরো পুরনো সময়।