সেযুগের ডাকসাইটে ব্যবসায়ী মতিলাল শীল। তবে শুধু অর্থ উপার্জন নয়, করেছিলেন অঢেল দান-ধ্যান। আসুন, আজ শুনে নিই তাঁর কথা।
বরাবর তিনি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। তবে লুকিয়ে রাখতে চাইলেই কি আর লুকিয়ে থাকা যায়? সত্য তো প্রকাশ্যে আসবেই। আর তাই উনিশ শতকের বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস চর্চায় মতিলাল শীলের নাম আজও মনে থেকে গেছে সকলের। প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে নিঃশব্দে তিনি করে গেছেন অঢেল অনুদান, বিদ্যাচর্চা আর সমাজ সংস্কারমূলক বিভিন্ন কাজ।
সালটা ১৭৯২। কলকাতার বিখ্যাত সুবর্ণবণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মতিলাল। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তিনি হারান তাঁর বাবাকে। কিন্তু এই বিপত্তি সত্ত্বেও মতিলাল একবিন্দু বিচলিত হননি। বরং একবারে নিজেকে নিঙড়ে দিয়েছেন বড় হওয়ার লক্ষ্যে। ইস্কুল কলেজের গড়পড়তা শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ মেলেনি। কিন্তু তাতে কী? নিজের একাগ্রতার বশে তিনি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, এবং শরীরচর্চাতেও হয়ে উঠেছিলেন বিশারদ। একদম শুরুর দিকে তিনি একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি নেন, বিবাহও করেন মাত্র সতের বছর বয়সে। স্ত্রী নাগরী-ও ছিলেন তাঁর যথার্থ সহধর্মিণী। স্বামীকে দেশের-দশের কাজে এগিয়ে যেতে প্রভূত সাহায্য যে তিনি করেছিলেন তা বলা বাহুল্য।
গোড়া থেকেই মতিলালের ঝোঁক ছিল ব্যবসার। তাই তিনি বিদেশি সংস্থায় কাজের পাশাপাশি শুরু করেন নীল, রেশম, চিনি, লোহা ইত্যদির আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা। ব্যস! আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান। তবে এখানেই শেষ নয়। এরপর শুরু করেন ময়দার ব্যবসা। তবে শুধু ময়দা নয়, সেই ময়দার বিস্কুট তৈরি করে তিনি তা পাঠাতে শুরু করলেন অস্ট্রেলিয়ায়। আর এই ব্যবসাতেই তিনি বিপুল লাভের মুখ দেখলেন। তবে এখনও বিস্ময়ের খানিক বাকি আছে। ব্যবসা থেকে এত অর্থ-সম্পদ উপার্জন করার পরেও তিনি থেমে থাকেননি। তাই এবার দ্বিগুণ উদ্যমে তিনি শুরু করলেন আরেকটি কাজ। তা হল জাহাজের ব্যবসা। সেই সময় ১৩টি বাণিজ্য জাহাজের মালিকানা পান তিনি।
আরও শুনুন: বাঘের সঙ্গে লড়তেন খালি হাতেই! বিদেশি সেনাবাহিনীতে কর্নেল তকমা আদায় সাহসী বাঙালির
তবে এই বিপুল লক্ষ্মীলাভের মধ্যে কিন্তু মোটেই থেমে থাকেনি তাঁর সারস্বত চর্চা। ১৮১৫ সালের দিকে তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে চাকরি পান। সেখানে কাজ করার সময়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রসরবরাহ করার বরাত আসে। কিন্তু ততদিনে মতিলাল ব্যবসা ছেড়ে গভীরভাবে মন দিয়েছেন সমাজের কাজে। তাই সেই প্রস্তাব সোজা নাকচ করে যোগ দিলেন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে। ১৮১৭ সালে তাঁর অসামান্য সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হল হিন্দু কলেজ। শুধু তাই নয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের জন্য সেই সময়ে তিনি বারো হাজার টাকা দান করেছিলেন।
যে সময়ের কথা বলছি সে সময় কলকাতায় ব্যাপকভাবে চলছে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার। বাদ যায়নি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজও। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের বিরুদ্ধে জোরাল প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। এমনকী কলেজের ছাত্রদের কাছ থেকে চাওয়া অধিক ফিজের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ১৮৪১ সালে তিনি বেলঘরিয়ায় একটি ভিক্ষাগৃহ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে প্রতিদিন ৫০০ জন লোককে খাওয়ানো হত। আর তাঁর কর্মকৃতিত্বের শ্রেষ্ঠতম কাজটি হল নিজের বাড়িতে কলেজ প্রতিষ্ঠা। ১৮৪২ সালের মার্চ মাসে, তাঁর বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হয় একটি ফ্রি কলেজ। আর এসবের পাশপাশি তিনি পুরোদস্তুর শুরু করেছিলেন বিধবাবিবাহের পরিকল্পনা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে এই কাজে সহায়তা করতে তিনি সেইসময় এক হাজার টাকা বখশিস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে বিধবাকে বিয়ে করলেই পাত্রপক্ষ পাবে হাজার টাকা, এই ছিল মতিলালের ঘোষণা।
শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখের স্মৃতিচারণায় বারবার মতিলাল শীলের প্রসঙ্গ পাওয়া গেছে। এক কথায় উনিশ শতকীয় নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তি তিনি। যে সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি বাংলার মাটিতে পা রেখেছেন, সেই সময় বাংলায় ছিল বড়লোক বাবুদের অপব্যয়ের প্রতিযোগিতা। বেশ কিছু টাকার মালিক হলেই তাঁরা পায়রা ওড়াতেন, পিছপা হতেন না কুকুর-বিড়ালের বিয়ে দিতে। লাগামহীন উদ্যাম জীবনযাপন ছিল তাঁদের একমাত্র চাহিদা। অথচ এর ঠিক উলটোদিকেই ছিল মতিলাল শীলের মতো মানুষরা। যারা আজীবন প্রচারের আলো থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে নিভৃতে করে গেছেন সমাজ-সাধনা। তাহলেই ভাবুন, এমন কতই না প্রবাদপ্রতিম মানুষের নাম লুকিয়ে আছে আমাদের বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে।