শাসক মানেই যেন আধিপত্যের চূড়ান্ত প্রদর্শন। অনেক সময়ই ঔদ্ধত্যের প্রকাশ হয়ে ওঠে মাত্রাছাড়া। কিন্তু এই বাংলাই একসময় দেখেছে ঠিক বিপরীত ঘটনাও। দেখেছে এমন এক শাসককে, যিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহের উপরে পড়ুক মানুষের পায়ের ছাপ। কে তিনি?
এককালে তার নাম ছিল ‘মুখসুদাবাদ’। পরবর্তীতে বদলে গেল নাম। অবিভক্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী হিসেবে সেই নগরকেই বেছে নিলেন তৎকালীন নবাব। তাঁর নামেই এ শহরের নাম বদলে গিয়ে হল মুর্শিদাবাদ। হ্যাঁ, সেই সময়ের বাংলার এই রাজধানী নগরীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। আর তাঁকে নিয়েই এই গল্প।
আরও শুনুন: গঙ্গাস্নান সেরে করতেন গোপালের নিত্যপূজা, কে এই ‘হিন্দু’ সাহেব?
শোনা যায়, জন্মসূত্রে নাকি দাক্ষিণাত্যের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। কিন্তু ছোটবেলাতেই তাঁকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয় এক ইরানি বণিকের কাছে। নিজের ছেলের মতোই তাঁকে দেখতেন ওই বণিক। নাম রেখেছিলেন মহম্মদ হাদি। কিন্তু শৈশবের এই পালাবদলই হয়তো পরবর্তী নবাবকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, জীবন আসলে কতখানি অনিত্য। সেইজন্যই হয়তো ভবিষ্যতে এক অভিনব সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজির গড়েছিলেন তিনি।
বড় হওয়ার পর ভারতে ফিরে আসেন হাদি। মুঘল দরবারে কাজও জুটিয়ে ফেলেন। দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগে কাজ করতে করতে খোদ সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি, যার ফল বাংলার দেওয়ান হিসেবে তাঁর নিয়োগ। বাংলার সুবাদার তখন সম্রাটের নিজের নাতি, অথচ তাঁর বিলাস ব্যসনের দৌলতে করের টাকা বাদশাহের দপ্তর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছয় না। এই পরিস্থিতিতে হাদি যখন বাংলার রাজস্ব বাবদ এক কোটি টাকা তুলে দিলেন বাদশাহের হাতে, তখন আর তাঁর উন্নতি আটকায় কে! নতুন উপাধি পেলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। অনুমতি পেলেন নিজের নাম অনুসারে মুখসুদাবাদ শহরের নাম পালটানোরও। এদিকে ১৭০৭ সালে মৃত্যু হল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের। দিল্লি দরবারের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগে নিজেকে বাংলার নবাব বলে ঘোষণা করলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তাঁর রাজধানী হল মুর্শিদাবাদ।
আরও শুনুন: কেবল শাহজাহান নন, প্রিয়জনের স্মৃতিসৌধ গড়েছিলেন ভারতের এই রানিরাও
ছিলেন ক্রীতদাস, হলেন নবাব। তবুও অহংকার যে তাঁকে একেবারে গ্রাস করতে পারেনি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় নবাবের শেষ ইচ্ছেয়। কাবা মসজিদের অনুকরণে কাটরা মসজিদ গড়ে তুলেছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। আর এই মসজিদের সিঁড়ির নিচেই রয়েছে তাঁর সমাধি। নবাব চেয়েছিলেন তাঁর সমাধির ওপর দিয়েই মানুষের যাতায়াত হোক। মানবের পদচিহ্ন পড়ুক তাঁর বুকে। এক জীবনে যা কিছু অন্যায় অপরাধ জমেছে, এভাবেই মুছে যাক তার ভার, এমনটাই আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। তাই আজও সকলের যাতায়াতের পথে ধুলোর নিচে শুয়ে আছেন সুবে বাংলার প্রথম নবাব। ঐশ্বর্য, নাম, যশ, সকলেরই যে শেষ গন্তব্য ধুলোতেই, এ কথাই যেন মনে করিয়ে চলেছেন তিনি।