অসময়ের বৃষ্টি শৈত্য নামিয়েছে মহানগরের বুকে। শীতকাল আর বৃষ্টির যুগলবন্দি মেনে নিতে গিয়ে বিপাকে বাঙালি। কিন্তু শীতে যে বৃষ্টি হতেই পারে, সে বিষয়ে বহু আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন লীলাবতী অর্থাৎ খনা। বহুকাল পেরিয়েও বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে আছে খনার সেই বচন। লিখছেন সৌভিক রায়।
ভাস্কর চক্রবর্তীর মতো বাঙালির প্রশ্ন ছিল, শীতকাল কবে আসবে? হাওয়া অফিস দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে জানাল বাইশ বছরে সবচেয়ে উষ্ণতম নভেম্বর কাটিয়ে ফেলেছে তিলোত্তমা। ডিসেম্বরের শহরেও দিব্যি ‘নাইট ওয়াচম্যানের’ মতো ব্যাটিং চালাচ্ছিল সিলিং ফ্যান। লেপ, কম্বল তখনও ডাগ আউটে বসে। তারপর শহরে বৃষ্টি এল, অসময়ের বৃষ্টি শৈত্য নামাল মহানগরের বুকে। কিন্তু অঘ্রানে বৃষ্টি? হতেই পারে। অগ্রহায়ণে বৃষ্টি নিয়ে বহু আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন লীলাবতী অর্থাৎ খনা। সম্ভবত তিনিই বাংলার ভাষার প্রথম মহিলা কবি। আবহাওয়া, কৃষিকাজ নিয়ে তাঁর অঙ্কের মতো গণনাকে আজও ছন্দে মুড়ে রেখেছে বাঙালি। আবহমান কাল জুড়ে তাই-ই স্মরণ করা হচ্ছে।
আরও শুনুন: সাত ভাই চম্পা বা অরুণ-বরুণ-কিরণমালা, বোনের ভাইকে আগলে রাখাই বাঙালির রূপকথা
অগ্রহায়ণে বৃষ্টি নিয়ে কী বলেছেন খনা?
‘যদি বর্ষে আঘনে
রাজা যায় মাগনে।’
অগ্রহায়ণ হল নবান্নের সময়, আমন ধান ওঠার সময়। এই সময় বৃষ্টি হলে চাষের ক্ষতি হয়। মাঠের ফসল মাঠেই নষ্ট হয়। শস্য ধ্বংস হলে রাজাকেও মাগনে অর্থাৎ ভিক্ষা করতে বেরোতে হয়। বাংলায় এই সময়টাতে আলু চাষ শুরু হয়, ফলে অঘ্রানের বৃষ্টি বাঙালির ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস’-এর জন্যও ক্ষতিকর।
তবে অঘ্রানের বৃষ্টি নাকি কাঁঠালের জন্য উপকারী। খনার বচন বলছে,
‘অঘ্রানে যদি না বৃষ্টি পড়ে।
গাছে কাঁঠাল নাহি ধরে।।’
অগ্রহায়ণে বৃষ্টি না হলে, কাঁঠালের ফলন ভালো হয় না।
এর আরও দুটি রূপান্তর রয়েছে। সেগুলো ওপার বাংলায় বেশি প্রচলিত।
ক) যদি না হয় আগনে বৃষ্টি,
তাহলে না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি।
খ) যদি না হয় আগনে পানি,
কাঁঠাল হয় টানাটানি।
পঞ্জিকা বলে পৌষ, মাঘ শীতকাল। তবে কার্তিক থেকেই শুরু হয় হেমন্তের হিমেল পরশ, অগ্রহায়ণে জাঁকিয়ে বসে শীতের কামড়। শীতের প্রধান দুই মাস, অর্থাৎ পৌষ ও মাঘের বৃষ্টি নিয়েও বিধান দিয়ে গিয়েছেন খনা।
‘যদি বর্ষে পৌষে,
কড়ি হয় তুষে।’
পৌষে বৃষ্টি হলে, অঘ্রানে ওঠা ধান থেকে চাল উৎপাদন বিলম্বিত হয়। চাহিদা বাড়ে, পাল্লা দিয়ে চালের দামও বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে ধানের তুষ বেচেও নাকি টাকা পাওয়া যায়। পৌষের বৃষ্টি কৃষকদের জীবনে লক্ষ্মী হয়ে আসে থুড়ি আসত। এ যুগে চালের দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা ফুলে ফেঁপে ওঠেন। কৃষকের আর্থিক পরিস্থিতির কোনও বদল হয় না।
‘যদি বর্ষে মকরে,
ধান হবে টিকরে।’
মকর সংক্রান্তিতে বৃষ্টি হলে ধানের ফলন ভালো হয়। টিকর অর্থাৎ উঁচু জমি, সংক্রান্তির বৃষ্টি উঁচু জমিতেও ভালো পরিমাণে ধান ফলায়।
আরও শুনুন: ধর্মের সঙ্গে যোগ নেই আমিষের! ইলিশ ভালবাসতেন ‘সিদ্ধপুরুষ’ বিবেকানন্দও
মাঘ নিয়ে রয়েছে-
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ,
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ’
মাঘের শেষে বৃষ্টিপাত, রাজা ও তাঁর সাম্রাজ্য অর্থাৎ দেশের জন্য কল্যাণকর। মাঘ মাসের শেষের দিকে বৃষ্টি হলে কৃষি কাজ ভালো হয়। মাঘ মাস হল রবিশস্যের মরশুম। চাষাবাদ ভালো হলে কৃষকের গোলা ভরে উঠবে, উপার্জন হবে। খাদ্যাভাব থাকবে না। সেকালে মাঘের বৃষ্টির জেরে ফলন ভালো হলে, পুণ্যাহের সময় খাজনা দিতে কৃষকদের সমস্যা হত না। এক কথায়, মাঘের বৃষ্টি আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। এ সময় বৃষ্টি আমের মুকুলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এর আরেকটি রূপান্তর রয়েছে,
‘মাঘ মাসে বর্ষা দেবা।
রাজা ছাড়ে প্রজার সেবা।।’
বচন নিছক পদ নয়, বাস্তব পরিস্থিতির এক প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে খনার বচনে। সাহিত্যের প্রাচীনতম ধারাটি যে কাব্য তাও বোঝা যায়। খনার বচন হিসেবে পদগুলো বহুলপ্রচলিত। বংশপরম্পরায় বচনগুলো বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর মর্মার্থও অতি সহজ, এর সঙ্গে প্রকৃতি, কৃষি কাজ মিশে রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে সম্ভাব্য আর্থিক পরিস্থিতির রূপরেখা। হয়তো সব বচন খনার লেখা নয়, কিন্তু তাঁর ‘ব্র্যান্ডনেম’-এর অধীনে যুগে যুগে মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে এইসব অক্ষর।
[ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়]