বিয়ের পর এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে আসছে নতুন জামাই। সুতরাং সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে বাড়িতে। কেউ পুকুরে জাল ফেলছে, তো কেউ ভিয়েনে মিষ্টির পাক দিচ্ছে। কেউ আলপনা দিচ্ছে তো কেউ সাজাচ্ছে মঙ্গলঘট। সব মিলিয়ে হইহই ব্যাপার, রইরই কাণ্ড। কিন্তু এত হট্টগোলের মধ্যেও খোদ কর্তামশাইয়ের কপালে ভাঁজ। জামাইকে নাকাল করার পরিকল্পনাটা ভাবতে ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠছিলেন তিনি। আর তাঁর এই ভাবনাচিন্তা থেকেই ঘটেছিল এক বড়সড় কাণ্ড। কী ঘটেছিল সেদিন উনিশ শতকের সেই জমিদারবাড়িতে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
জামাইষষ্ঠীর দিনটিতে শ্বশুরবাড়িতে যে জামাই আদরে ভাসাভাসি কাণ্ড হয়, সে কথা তো ঠিকই। কিন্তু ফুলের মধ্যে যেমন ছোট্ট কাঁটা থাকে, তেমনই জামাইকে আদর করার আড়ালে আড়ালে চলতে থাকে তাকে নাকাল করার ষড়যন্ত্রও। আসলে সেকালে তো দুই বাড়ির মধ্যে ঘন ঘন যাতায়াতের চল ছিল না। সেখানে একদিন যখন জামাইঠাকুরকে কাছে পাওয়া গিয়েছে, তখন শ্যালক-শ্যালিকাদের এতদিনের জমিয়ে রাখা সব আদর আবদার ঝাঁপিয়ে পড়ত জামাইবাবুর উপরে। কথায় কথায় শোনা যায়, এককালে নাকি জামাইষষ্ঠী মানেই শ্যালক-শ্যালিকাদের দলবল নিয়ে সিনেমা থিয়েটারে যেতে হত জামাইকে। আর তার মানেই পকেটে বড়সড় ফাঁক। এসব ছাড়াও সেদিন জামাইকে ঠকিয়ে নির্মল আনন্দ উপভোগ করত সকলে। আর সেই আনন্দের সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছিল আজকের দিনের খুব চেনা সন্দেশ- জলভরা।
আরও শুনুন: ভূরিভোজে সন্তুষ্ট করতে হবে জামাইকে… কোথা থেকে এল এই জামাইষষ্ঠীর রীতি?
ভাবছেন তো, জামাইষষ্ঠীর দিনে জামাইয়ের গালে যাওয়া ছাড়া সন্দেশের আর কী ভূমিকা থাকতে পারে? তাহলে গল্পটা খুলেই বলা যাক।
জলভরা যে কোন ময়রার স্পেশালিটি, সে কথা জিজ্ঞেস করলে সকলেই একবাক্যে বলবেন চন্দননগরের সূর্যকুমার মোদকের নাম। হ্যাঁ, প্রথম জলভরা সন্দেশ বানিয়েছিলেন তিনিই। আর সেই মিষ্টি বানানোর উপলক্ষ্য ছিল এক জামাইষষ্ঠীই।
হয়েছিল কি, তেলিনীপাড়ার জমিদার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে সেবার নতুন জামাই আসার কথা। যদিও তখন ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়ে গিয়েছে। লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তন করা সূর্যাস্ত আইনের চক্করে পড়ে জমিদারি গিয়েছে বাংলার অধিকাংশ জমিদারের। কিন্তু জমিদারি থাক আর যাক, ঠাটবাট বজায় আছে ষোল আনা। আর তাই, জামাই আসার প্রাক্কালে জমিদারবাড়িতে তলব পড়ল এলাকার নামকরা ময়রা সূর্যকুমার মোদকের। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল, নতুন জামাইয়ের সম্মানে বানাতে হবে নতুন মিষ্টি। যেমন মিষ্টি জামাই কোনও দিন খায়নি। কিন্তু সেই সম্মানের আড়ালেই লুকিয়ে রইল একটুখানি ছোট্ট হুল। জমিদারবাবু জানিয়ে দিলেন, ওই মিষ্টিতেই এমন কোনও কারিকুরি করতে হবে, যাতে রীতিমতো বোকা বনে যায় জামাই। এক ঢিলে দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত আর কি। জামাই বাবাজীবনকে ঠকানোও হবে, আবার তিনি রাগও করতে পারবেন না।
আরও শুনুন: রান্নাপুজো: বাংলার নিজস্ব এই সংস্কৃতির ধারা আজও বইছে ঘরে ঘরে
ভেবেচিন্তে এমন একটা মিষ্টি বানালেন মোদক মশাই, যার বাইরেটা কড়াপাক, কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা। আর সেখানেই ভরা রইল মিষ্টির রস। যেই না কামড় দেওয়া, রস ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিল জামাইয়ের সাধের নতুন জামা। আর সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ল উপস্থিত সকলে। জামাই ঠকলেন বটে। কিন্তু বাজারে রমরমিয়ে চলতে লাগল সেই নতুন সন্দেশ, যার পোশাকি নাম ‘জলভরা’।