রানি রাসমণি। এই নাম উচ্চারিত হলেই মনে ভেসে ওঠে একজন শান্ত নারীর মুখ। বাংলার এক অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে একসময় হয়ে উঠলেন জানবাজারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রানিমা। নিষ্ঠাভরে দুর্গাপুজো করতে গিয়ে একবার তাঁকে কাঠগড়ায় পর্যন্ত উঠতে হয়েছিল। এক নেটিভ নারীর সঙ্গে এক সাহেবের মামলার সেই গল্প আজও ঐতিহাসিক।
সেবার এক সপ্তমীর ভোরে জানবাজারের রানি রাসমণি বাড়ির কলাবৌ গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। বাজনদারেরা হাত খুলে বাজাচ্ছে আর চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। বচ্ছরকার দিনের জন্য রানির থেকে ভালই বায়না পেয়েছে তারা। কোথাও কোনও খামতি থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। জানবাজার থেকে গঙ্গার ঘাট অবধি রাস্তায় শোভাযাত্রা। শুরু হয়েছিল তিথি মেনেই। এদিকে এলাকায় বসবাসকারী এক সাহেবের তখনও বিছানা ছাড়ার সময় হয়নি। তিনি অসময়ের এই অহেতুক কোলাহলের কারণ বুঝতে পারলেন না। কাঁচা ঘুম ভেঙে লালমুখো সাহেবের মুখ আরও লাল হয়ে উঠল। সাহেব তৎক্ষণাৎ পেয়াদা পাঠালেন এই হই-হট্টগোল আর কান-ঝালাপালা করা আওয়াজ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু রানির বাজনদারেরা সে কথায় পাত্তা দেবে কেন? উলটে তারা সাহেবের পেয়াদার সামনেই আরও জোরে জোরে বাজাতে লাগল। পেয়াদা এসব গিয়ে সাহেবকে জানাল। সাহেব রাগে অপমানে তখনই ঠিক করলেন মামলা করবেন রানির নামে। খবর যেমন সাহেবের কাছে গেল, তেমন রানির কাছেও গেল।
আরও শুনুন:
কেবল বাংলায় নয়, দুর্গাপূজার আবহে পুজো চলে সারা দেশ জুড়েই
প্রীতিরাম দাসে-র পুত্রবধূকে লোকে এমনি এমনি ‘রানিমা’ বলতেন না। তিনি শুদ্রাণী হতে পারেন কিন্তু তাঁর পরাক্রমে তখন বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তিনি সব শুনে বললেন, করতে দাও মামলা। তারপর দেখছি। যথাসময়ে মামলা আদালতে উঠল। ইংরেজের আমলে, ইংরেজ সাহেবের আনা মামলা এক নেটিভ নারীর বিরুদ্ধে। ফলে যা হওয়ার তাই হল। মামলায় হেরে, বলা ভালো ইংরেজ সাহেবের ঘুমে ব্যাঘাত দেওয়ার কারণে রানিকে জরিমানা গুনতে হয়েছিল ৫০ টাকা। তখনকার দিন যার মূল্য মোটেও কম ছিল না। কিন্তু তাতে কী! তা বলে বাজনা-বাদ্যি সহ নিষ্ঠাভরে দুর্গাপুজো হবে না! সাহেবের ভয়ে সেদিন বাজনা থামাননি রানিমা। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। আর তাই তো, এতকাল পেরিয়েও আজও রানিমার সাহস, সিদ্ধান্তকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন বাংলার মানুষ।
এরপর সাহেবের এই চালের মাত দিলেন রানি । কীভাবে? তাহলে একটু গোড়ার গল্প বলতে হয়।
আরও শুনুন:
সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো করতেন বঙ্কিমচন্দ্র, অঢেল দানে হাসি ফুটত গরিবের মুখেও
অষ্টাদশ শতকের কলকাতায় প্রীতিরাম দাস, নামী ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। জানবাজার এলাকায় তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি, ঠাকুরদালান দেখতে লোক ভিড় করত। ১৮৯৪ সাল থেকে সেই ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু করেন প্রীতিরাম দাস। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পুত্রবধূ রাসমণির হাতে জমিদারির যাবতীয় দায়িত্বের সাথে সাথে সেই পুজোর দায়িত্বও আসে। রাসমণি দেবী নিষ্ঠাভরে যেমন পুজোর দায়িত্ব সামলান তেমনই দক্ষভাবে প্রজাদেরও সামলান। প্রীতিরাম দাস গঙ্গায় বাঁশ ভাসিয়ে নিয়ে এসে এখানে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যে বাঁধনে সেগুলো একসাথে বাঁধা হত তাকে বলা হত মাড়। সেই বাঁধনেই রানি এবার ইংরেজদের জব্দ করবেন ঠিক করলেন। রানিমা তখন তাঁর জামাই মথুরবাবুকে ডেকে বললেন, কয়েকশো ভাল বাঁশ আর মোটা মোটা কাছির ব্যবস্থা করতে। মথুরবাবু কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি জানান, বেঁধে রাখব। আমার বাড়ি থেকে বাবুঘাট অবধি রাস্তা, যে রাস্তায় বাজনদারেরা শোভাযাত্রা করে কলাবৌ গঙ্গাস্নানে নিয়ে গিয়েছিল সে রাস্তা আমি বানিয়েছি। সে রাস্তা বাঁধ দিয়ে রাখব। আমার অনুমতি ছাড়া কোনো গাড়ি – ঘোড়া চলতে পারবে না সে পথে। প্রসঙ্গত এখনকার বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট রানি রাসমণিই তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রজাদের সুবিধার জন্য। বুঝতেই পারছেন রানির রোষে যদি ওই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা সাহেবদের জন্য বন্ধ থাকে তাহলে কতটা অসুবিধা হতে পারে। অবশেষে কোম্পানির চাপে সেই সাহেব রানিমার সাথে মিটমাট করে নিল। আর রানির প্রজারা ছড়া কাটল – ‘অষ্টঘোড়ার গাড়ি দৌড়ায় রানি রাসমণি / রাস্তা বন্ধ কর্ত্তে পারলে না কোম্পানি’।
দুর্গাপুজোর মাধ্যমে আমরা শক্তির পুজো করে থাকি ‘মা’ রূপে। ১৮০০ শতকের রাসমণি দেবী যেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে, সমাজের নানা প্রচলিত কুপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শক্তিরই অপর নাম বিশেষ।