হালখাতা শব্দটা কারও পরিচিত নয়। রাস্তার ধারে আলাদা করে দোকান থাকবে, এমনটাও ভুলেছেন অনেকেই। এরকম একটা সময় শপিং মলে হালখাতার ইভেন্ট। সেখানেই খুঁজে পাওয়া বাঙালির হারিয়ে যাওয়া পয়লা বৈশাখ আর হালখাতার গল্প। টাইমট্রাভেল করে সেই অভিজ্ঞতা শোনালেন শুভদীপ রায়।
অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক।
১৩’এপ্রিল, ২০৭২
আজ সকাল থেকেই কেমন একটা মনখারাপ। মনে পড়ছিল ছোটবেলার কথা। বছরের এই সময়টা একবার হলেও ঝড় হত। ‘কালবৈশাখী’ বলত সবাই। ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে দেখতাম কালো মেঘ। সেই মেঘ কোথায় এখন? কোন জানলায় এসে দেখা দেয়? ছেলেবেলাতেই কি ফেলে এলাম সেই জানলাখানা? কালবৈশাখী আসে কালেভদ্রে, মাঝেমধ্যে সাইক্লোন। আগেভাগে সতর্কবার্তা চলে আসায়, ক্ষতি তেমন হয় না। যাইহোক, মনখারাপ কাটাতে ভিআর রুমে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়েছি। আজ সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলাম। পৃথিবী থেকে পেঙ্গুইন বিলুপ্ত হয়েছে বহুদিন, কিন্তু সুইজারল্যান্ডের মিউজিয়ামে এখনও কয়েকটা স্যাম্পল আছে। কাচের ওপার দিয়ে দেখলাম। বরফ জমা রাস্তাঘাট। চোখের আরাম হল, হয়তো শরীরেও। কয়েক ঘণ্টা ওইভাবে নষ্ট করেছি। খিদের চোটে বাইরে এলাম। সারাদিন তেমন কাজ হয়নি। দুপুরে জমে থাকা কাজ শেষ করেছি। বিকেলের দিকে একটা হোয়াটস্যাপ মেসেজ। হাউজিংয়ের গ্রুপে। কীসের একটা ইনভিটেশন! খুলে দেখি, ‘হালখাতার’ নিমন্ত্রণ। এই শব্দটাও ছোটবেলার। এককালে শপিংমলের জায়গায় দোকান থাকত রাস্তার ধারে। জামা-কাপড়, গ্রসারি, জুতো, ব্যাগ– সবই মিলত আলাদা আলাদা দোকানে। সেখানেই নাকি বছরে একবার এই ‘হালখাতা’ হত। কিন্তু এখন তো সেসবের বালাই নেই, তাহলে হালখাতা কেন? কী হবে? সেসব স্পষ্ট করে লেখা নেই। গ্রুপেই কয়েকজন প্রশ্ন করেছে, সবাইকে স্রেফ একবার আসার অনুরোধ করেছে শপিং মল কর্তৃপক্ষ। এমনিতে আজকাল শপিং মলে গিয়েও খুব একটা কেনাকাটা কেউ করে না। বাইরে বেরোলেই মাস্ক পরার ঝক্কি, বাড়ি ফিরে স্যানিটাইজার ঘষা, বিস্তর ঝামেলা। অনলাইনেই সব প্রয়োজন মিটে যায়। তাই সকলের প্রশ্ন, কী এমন হবে ওই হালখাতার অনুষ্ঠানে! আমি ভাবছি একবার ঘুরে আসব। যাইহোক, কাল ভেবে দেখব।
১৪’এপ্রিল, ২০৭২
আজ পয়লা বৈশাখ। মোবাইলে নোটিফিকেশন এল। হালখাতার ব্যাপারটাও যে সেইজন্য, সেটা সকালে খেয়াল করলাম। ছোটবেলায় এইসময় একটা-দুটো নতুন জামা হত। খুব ভুল না করলে সেসব পরতাম এইদিনেই। এখন আর বিশেষ দিনে নতুন জামা কেনার বালাই নেই। প্রয়োজন হলে, অনলাইনে অর্ডার করে নেওয়া যায়। আজ রোজনামচার কথা একটু বেশিই বলব। কেন, তা লেখার শেষে বোঝা যাবে। ভবিষ্যতে কেউ যদি এই ডায়রি পায়, তাহলে অন্তত বুঝবে ঠিক কেমন ছিল এই সময়ের পৃথিবী। আজ সারাদিন বেশ অন্যরকম কাটল। অবশ্য ‘সারাদিন’ বলা ভুল, বিকেলের পর থেকে বাকিটা। কারণ ওই হালখাতার অনুষ্ঠান। বাড়ি ফিরেছি মিনিট পনেরো আগে। ফ্রেশ হয়েই ডায়রিটা নিয়ে বসেছি। সকালের দিকে একবার ভিআর রুমে গিয়েছিলাম। বরফ দেখতে বড্ড ভালো লাগছে আজকাল। বিকেলে একটা পুরনো পাঞ্জাবি পরলাম। বাঙালিদের অনুষ্ঠান, একটু ড্রেসকোডটা খেয়াল রাখতেই হয়। রাস্তায় অবশ্য তেমন কাউকে চোখে পড়ল না। মাস্ক আর চশমায় যতটা সম্ভব নিজেকে ঢেকে ভিনসেন্ট মলে পৌঁছে গিয়েছিলাম পৌনে পাঁচটা নাগাদ। ওখানে অবশ্য কয়েকজন ছিল। পরিচিত নয়, হলেও কথা বলার উপায় নেই। রাস্তাঘাটে সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা এখনও নিষিদ্ধ। ভাইরাস নেই, তাও সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এসবের মধ্যেও অফলাইন প্রোগ্রাম আয়োজন করেছিল মল কর্তৃপক্ষ। ভিতরে ঢুকে দেখলাম, সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারদিক। ছোটবেলায় হালখাতা হচ্ছে এমনটা দেখিনি কখনও। আজ দেখলাম। মলের ভিতর পাশাপাশি কয়েকটা স্টল রাখা ছিল। কোনওটায় বই, জামা-কাপড়, জুতো এমনকী, গ্রসারি আইটেম সাজানো। সব দোকানের বাইরে একজন করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসে ছিল। একটা একটা ট্যাবে কীসব নোট করছিলেন তাঁরা। কাছে গিয়ে বুঝলাম, এখানে ক্রেডিট কার্ড রিনিউ করা হচ্ছে। দোকানের জিনিসগুলো স্রেফ দেখানোর জন্য। হালের বাঙালিকে পুরনো দিনের কথা মনে করানোর জন্য। মোটের উপর একটা আন্দাজ করলাম, হালখাতা আসলে হিসাব রাখার খাতা– এই ধরনের কিছু। ব্যাপারটা পরিষ্কার হল আরও কিছুক্ষণ পর। শুরু হল অনুষ্ঠান। এটা অফলাইনে করা সম্ভব হয়নি। বোধহয় আর্টিস্টরা জনসমক্ষে সামনে অনুষ্ঠান করতে স্বচ্ছন্দ নন। বড় একটা জায়ান্ট স্ক্রিন রয়েছে, পাশে বড় স্পিকার, সেখানেই গান শোনাচ্ছেন একের পর এক শিল্পী। বাংলা গান খুব একটা শোনা হয় না, অনেক দিন পর শুনলাম অনুষ্ঠানে। একটা গানে কালবৈশাখীর কথাও বলা হল, ঠিক মনে নেই। এসবের মাঝেই টি-ব্রেক হল। ফ্রুট জুস, ওয়াইন, সবই ছিল। গলা ভিজিয়ে আরও কিছুক্ষণ গান শুনলাম। ক্রেডিট কার্ডের বিল যথাসময় অনলাইনে পেমেন্ট হয়ে গিয়েছে। তাই আলাদা করে ওই স্টলে যায়নি। অনেক দিন পর সামনে থেকে ক’জনের সঙ্গে কথা হল আজ। ভদ্রলোক ইথিওপিয়ায় থাকতেন। বছর খানেক হল কলকাতায় এসেছেন। বাঙালি ট্রাডিশান সম্পর্কে ধারণা বলতে দুর্গাপুজোটাকেই বোঝেন। জানালেন, এতবড় আর্ট ফেস্টিভ্যাল তাঁর দেশে হয় না। যাইহোক, পয়লা বৈশাখ বা হালখাতা যে বাঙালি ট্রাডিশানের অন্যতম অধ্যায় সেটা বোঝানোর মতো জ্ঞান আমার নেই। কাজেই কথা বাড়াইনি বিশেষ। ঘণ্টা দুয়েক অনুষ্ঠান শেষ হলে বাড়ি ফেরার জন্য উঠলাম। গেট দিয়ে বেরোতে যাব, একজন হাতে এসে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গেল। স্যানিটাইজ না করে প্যাকেট খোলা যাবে না। তাও অন্তত ৮ ঘণ্টা আলাদা রাখতে হবে। আপাতত প্যাকেটটা বাইরের ঘরে রেখেছি। কী আছে ওটায়, কাল দেখব।
১৫’এপ্রিল, ২০৭২
সকালে উঠতে দেরি হয়েছে। কাজের চাপ ছিল। ভিআর রুমে যাওয়া হয়নি। দুপুরের দিকে মনে পড়ল, কালকের প্যাকেটটা খোলা হয়নি। চাপা একটা উত্তেজনা ছিল, কিন্তু দুপুরে আর দেখিনি। বিকেলে প্যাকটা নিয়ে বসলাম। মাঝারি মাপের একটা বাক্স। উপরে বাংলায় লেখা, ‘শুভ নববর্ষ’। সঙ্গে আরও কয়েকটা ভাষায় অনুবাদও করা আছে। বাক্স খুলে বেশ অবাক হলাম। একেবারে উপরে রাখা ছোট একটা গামছা। তার নীচে আরও দুটো বাক্স। খুলে দেখলাম মিষ্টি আছে। রসগোল্লা আর সন্দেশ। সঙ্গে একটা চিঠি। সেটা অবশ্য পুরো বাংলায় লেখা। নীচে একটা কিউআর কোড দেওয়া, স্ক্যান করলেই পছন্দের ভাষায় পড়ে নেওয়া যাবে। এই লেখাটা কী ভীষণ প্রয়োজন ছিল, না পড়লে বুঝতাম না। সবিস্তারে লেখা আছে, হালখাতার ইতিহাস। এই যে পয়লা বৈশাখ বা হালখাতার মতো শব্দগুলো আজ হারিয়ে গিয়েছে, একসময় তা উৎসবের মতো পালন করত বাঙালি। অনেক চেনা জায়গার অচেনা ছবি খুঁজে পেলাম লেখাটার মধ্যে। কলেজ স্ট্রিটের কথাটাই প্রথমে বলি। জানলাম, সেইসময় পরপর বইয়ের দোকান থাকত ওখানে। ঘটা করে পয়লা বৈশাখ পালন হত। লেখকরা আসতেন, পাঠকরা আসতেন, আড্ডা, গল্প, খাওয়া-দাওয়া সব হত। ছোটবেলায় এসব শুনেছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো তখন থেকেই বিষয়টা হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। আজকের কলেজ স্ট্রিট শুধু নামেই! শহরের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও শুধু ফ্ল্যাট আর অফিস। দেখে বোঝার উপায় নেই, একসময় কত পুরনো বাড়ি ছিল এখানে। আমিও জানতাম না এতকিছু, লেখাটা পড়ে বুঝলাম। আরও জানলাম, হাতিবাগান, শ্যামবাজার, গড়িয়াহাট, বাগুইহাটির বড় বড় বাজারে হালখাতা হত। সারা বছরের হিসাব মিটিয়ে নতুন করে লেনদেন শুরু। দোকানে ঘটা করে পুজো হত। কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরে ভিড় উপচে পড়ত। বউবাজার বলে যে রাস্তাটা আছে, ওখানে নাকি পরপর সোনার দোকান ছিল। হালখাতা হত ঘটা করেই। একসময় কেউ আর সোনা কিনবে না, সেটা তখনকার মানুষজন হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি। হালখাতার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল, সেটাও লেখা আছে ওই চিঠিতে। দোকানে লেনদেন করতে আসা ক্রেতাদের মিষ্টির বাক্স, ক্যালেন্ডার উপহার দেওয়া হত। ব্যাপারটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, কয়েক বছরে কতটা বদলেছে চারদিক। পেঙ্গুইন, কচ্ছপের মতো হারিয়ে গিয়েছে কতশত জীবিকা। সেসবের নামও জানে না অনেকে। আমিও জানতাম না। এই লেখা পড়ে, এআই অ্যাসিস্টান্টকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাঙালির হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস সে খানিক বলল। এই সময় নাকি গাজন বলে একটা উৎসব হত। অদ্ভুত সব রিচ্যুয়াল পালন করা হত সেখানে। ছবিও দেখলাম বেশ কিছু। এর আগেও পয়লা বৈশাখ এসেছে, এমনভাবে বাঙালির পুরনো ইতিহাস খুঁজে দেখার ইচ্ছা হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি। এবার হালখাতার দৌলতে সে সুযোগ হল। সামনের বছর এই দিনটায় কিছু হয় কি না, দেখতে হবে। আপাতত এই ডায়েরিতে নস্টালজিয়া বন্ধ রাখলাম। রাত অনেক হল, এবার শুতে হবে।