ফাল্গুন খানিক আবেগী, আর চৈত্র বেজায় প্র্যাকটিকাল। চৈত্রের প্রেমে কোনও আবহসংগীত লাগে না। খালি গলায় গান করার মতো। চৈত্রই যে সর্বনেশে, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। সেই জরুরি আত্মলোপী সর্বনাশের কাল, ব্যক্তিগত চৈত্রমাস– কবেই পণ্য হয়ে গিয়েছে। চৈত্রে যত সেল হয়েছে, চৈত্র ততটা সেলেব হয়নি।
পয়লার আগে চৈত্র-কথা লিখলেন, সম্বিত বসু।
অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক।
তেড়ে চৈত্র। বেড়ে রোদ্দুর। রবির কর জানলায়, তাই বন্ধ। দুপুর, সন্ধের দিকে রওনা হলে মুকুল আসে জানলায়। ঠিক মুকুল না, মুকুলের গন্ধ। এসে ঠকঠক করে। তখন খুলে দেওয়াই একমাত্র উপায়। এখনও সব আম– ওরে সবুজ, ওরে আমার কাঁচা। সেই চৈত্রকাল মনে পড়ে, মাঠে সাইকেল শিখতে এসেছে আনন্দ মুখার্জি লেনের মেয়েটি, একটি তীব্র মাঠ ‘ফিরে এসো চাকা’কে অজান্তেই উৎসর্গ করে, ক্রিকেট-উন্মাদ ছেলেরা ১৫ মিনিট বিরতি নিয়েছে। সামনে আধেকলীন বাড়ির প্রিয় বন্ধু আমগাছে চলছে হন্তদন্ত টিপ প্র্যাকটিস। দু’-চারটে খসে পড়লেই আমরা আম-আদমি। আমের রূপান্তর দেখাব। সহসা লঙ্কাগুঁড়ো, ১ টাকার ঠোঙায় নুন হাজির। সে এক দিন ছিল, আমাদেরই কেউ আলাদিন ছিল, প্রদীপের জিন ছিল, ‘ব্লিংক ইট’ ছিল না।
তারপর টাইমকলের জলে সামান্য ঘষে পথের ধুলোবালির স্মৃতি আমের গা থেকে হাপিশ। ১০-১২টি কিশোরপ্রধান ছেলে মাচায় বসে কাঁচা আম কামড়ে খাচ্ছে, তাদের দাঁতের দাগ নরম আঁটি পর্যন্ত গিয়েছে– এই অপ্রাপ্তবয়স্ক দৃশ্যে মেয়েটি সাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছিল কাছে। একপ্রকার লোভেই। তারপর থেকে কোনও দিন মাঠে সাইকেল চালাতে গিয়ে সে পড়ে যায়নি।
অথচ এমন ঘটনা চৈত্রে নয়, চিরাচরিত ফাল্গুনে ঘটলেই হত ভালো। কোকিলের সুবিধে হত। নইলে অসময়ে তাকে রেওয়াজ করতে হয়। ফাল্গুনে হাওয়া যখন বয়, তখন উড়িয়ে দিয়ে যেতে পারত অজস্র শ্যাম্পুকাব্য। গাছগাছালির তলায় পড়ে থাকত কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া-পলাশ। কিন্তু সেসব হল না। হল চৈত্রেই। ফাল্গুন খানিক আবেগী, আর চৈত্র বেজায় প্র্যাকটিকাল। চৈত্রের প্রেমে কোনও আবহসংগীত লাগে না। খালি গলায় গান করার মতো। চৈত্রই যে সর্বনেশে, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। সেই জরুরি আত্মলোপী সর্বনাশের কাল, ব্যক্তিগত চৈত্রমাস– কবেই পণ্য হয়ে গিয়েছে। চৈত্রে যত সেল হয়েছে, চৈত্র ততটা সেলেব হয়নি। বাংলা বছর পেলব হয়েছে শুধু। ক্যালেন্ডার দেওয়ালে দুলতে দুলতে অর্ধচন্দ্র এঁকে রাখে। ক্যালেন্ডার সরিয়ে নিয়ে দিব্যি চন্দ্রবিন্দু দেখা যায়।
জানলা দিয়ে যেটুকু ম্যাটিনি শো এই মাসে, দেখা যেত, পথকুকুরেরা সামনের দাওয়ায় ঘুমোচ্ছে। নাকের পাশ দিয়ে হয়তো মিষ্টির দানা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেজায় পরিশ্রমী মাসলওয়ালা কালো পিঁপড়ে। মাংস-মাছ নয়, লেজ নাড়তে নাড়তে চৈত্রের আমডাল দিয়ে ভাত খেতে দেখেছি ভুলু-ভ্যাটকাদের। যিনি দিচ্ছেন, তিনি এই সময় ছাড়া কোমরের ব্যথায় ঝুঁকতে পারেন না। এঁটোকাটা নিয়ে যথেষ্ট বাছবিচার আছে, কিন্তু শেষবেলায়, কানাউঁচু খাবারের থালাটি মাটিতে ঠন্ঠন্ করে বারদুয়েক শব্দ করে যেন কুকুরদের মিড ডে মিলের ঘণ্টা বাজাতেন। এমন এক চৈত্রেই, ভোরবেলা, তিনি বিদায় নিয়েছিলেন সারা পাড়া থেকে। কিন্তু হররোজ দুপুরবেলা মিড ডে অমিল থাকেনি পথকুকুরদের। ঠন্ঠন্ শব্দটি বাদ পড়েছে শুধু। চৈত্র-অভিধান আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, একটা মানুষ, আস্ত একটা প্রায় অপরিচিত মানুষ– মাঝে মাঝে একটামাত্র শব্দের প্রতিনিধি হয়ে থেকে যায়, থেকে যেতে পারে।
চৈত্র আসলে জানে, কোথায় থামতে হবে। সে বাংলা ক্যালেন্ডারের যতিচিহ্ন। তাই ব’লে– ‘জয় হোক বিচ্ছিন্নতার’ বলে সে শ্লোগান দেয় না। বাঙালির আষাঢ় আছে, কিন্তু চৈত্র আঠার মাস। সে ফুরোয়, কিন্তু ফুরোতে ফুরোতেও জুড়ে দেয় ঠিক। চৈত্রের পুর্নজন্ম হয়, পুনর্মরণও। ‘‘এখন চৈত্রের দিন নিভে আসে– আরো নিভে আসে;/এখানে মাঠের ’পরে শুয়ে আছি ঘাসে;/’’ – লিখছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সেই ‘আছে’ নামক কবিতার শেষ দুই পঙ্ক্তিতে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘‘এই স্তব্ধ মাটিতেই মিশে যেতে হ’লো জেনে তবু চোখ রেখে নীলাকাশে/ শুয়ে থাকা পৃথিবীর মাধুরীর অন্ধকার ঘাসে।’ এই অফুরান চেয়ে থাকা, আসলে চৈত্রেরও। যে আকাশ বদলে দিতে পারে, যে সতর্ক করে দেবে গ্রীষ্মের আগাম খবরে: পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, যত্ন নাও। যে বৈশাখ থেকে ধার নিয়ে, উপহার দিতে পারে এক-দেড়টা কালবৈশাখী। ফেরত দেব বলে, কিন্তু কখনও ফেরত দিতে পারে না।
যে কোনও জরুরি ফুরিয়ে-বুড়িয়ে যাওয়ার প্রতিই একটু ঝুঁকে থাকা ভালো, স্নেহ করা ভালো। ভালো, একটু কথা বলা। যে কোনও ক্ষতের গায়েই যেন কম না পড়ে লাল ওষুধ। দু’চারটে ভাঙা পেনসিল যেন পেনসিলবক্সে ঠিক থাকার জায়গা পেয়ে যায়। পঁচিশ পয়সা দিয়ে, মনে রাখবেন, এখনও টস করা যায় দিব্যি। যে জীবনের ক্লাসে অনুপস্থিত, তার জন্যও যেন রোল কল করা হয় মাঝে মাঝে। যে নতুন দিন আসছে, সে যেন মনে রাখে চৈত্রের ইতিহাস। নইলে এই নীলগ্রহ, একদিন ঠিক, ঘোরা থামিয়ে দেবেই।
ওই যে রাস্তা দিয়ে, ছিন্ন কাপড়ের মলিন হকার, হাঁক দিতে দিতে চলে গেলেন, কবি সুমন্ত মুখোপাধ্যায় দুপুরবেলার এই হাঁককেই বলেছিলেন একরকমের গান– সেই হাঁক শুধু পুরানা কাগজ, থালাবাসন, জামাকাপড়েরই ছিল না, সেই হাঁকে মিশে ছিল পুরানা চৈত্রমাসও। কেউ কেউ বিক্রি করেছে তা, কেউ কেউ করেনি।
আপনি কোন দলে?