মাতৃপক্ষেই মাতৃভাষার মাথায় উঠল নয়া মুকুট। ধ্রুপদী ভাষার সম্মান পেল বাংলা। ভাষাকে এই স্বীকৃতি এনে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বের পাথুরে প্রমাণ সংগ্রহ। সে কাজটিই দীর্ঘ পরিশ্রমে সম্পন্ন করেছেন ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ তথা আইএলএসআর-এর গবেষকেরা। তাঁদের তরফে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র সঙ্গে কথা বললেন ড. অমিতাভ দাস। শুনলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
“বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে
রোদ, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন”…
মাতৃভাষাকে ভালোবেসে এ কথা বলেছে বাঙালি। জন্মসূত্রেই সে এমন এক ভাষার শরিক, যে ভাষার অধিকার চেয়ে তৈরি হয়ে গিয়েছে একটা গোটা দেশ। যে ভাষার মর্যাদা চেয়ে রক্ত ঝরেছে বারবার। ‘ম’ মানে মরবে না মাতৃভাষা… ১৯৫২ সালের পর সে কথা ফের প্রমাণ হয়েছিল ১৯৬১ সালে। প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কিছু বাঙালিই। নিজেদের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, মাতৃভাষার অপমান রুখতে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়তেও তাঁদের বাধেনি। এতদিন পরে, আরও একবার অর্জন করা গেল সেই মাতৃভাষার প্রাপ্য মর্যাদা। ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেল বাংলা। নিরন্তর শ্রমে সেই মর্যাদা এনে দিলেন একদল বাঙালি গবেষক।
ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ তথা আইএলএসআর-এর গবেষক দলের তরফে, এ প্রসঙ্গে কী জানালেন ড. অমিতাভ দাস?
জানালেন, কোনও ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানাতে হয় কোনও রাজ্যকে। সঙ্গে জমা দিতে হয় পাথুরে প্রমাণ, যেসব তথ্য ও নথি প্রমাণ করবে যে ওই ভাষা ধ্রুপদী মর্যাদা পাওয়ার মতো প্রাচীন। সে মর্যাদা পাওয়ার মাপকাঠি হল ভাষাকে ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের প্রাচীন বলে প্রমাণ করা। তেমন প্রাচীন কোনও পুথিপত্র বা স্ক্রিপ্ট, প্রাচীনত্বের সমর্থক কোনও তথ্য খুঁজে এনে সেই শর্ত পূরণ করেন গবেষকেরা। এক্ষেত্রে সেই কাজটি করার জন্য রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর ভার দিয়েছিল আইএলএসআর-কে। ২০২২ সাল থেকে প্রাসঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ খুঁজে চলেছিলেন আইএলএসআর-এর গবেষক দল।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলতে চর্যাপদের কথাই বারবার উঠে আসে। এদিকে শহীদুল্লাহ অথবা সিলভ্যাঁ লেভি-র মতো তন্নিষ্ঠ গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, চর্যাপদের পদকর্তাদের কেউ কেউ সপ্তম-অষ্টম শতক পর্যন্তও জীবিত ছিলেন। তাহলে চর্যাপদকে ধরেও ১৫০০ বছরের প্রাচীনত্বে পৌঁছনো যাচ্ছে না। উপরন্তু, চর্যাপদ পদ্য ভাষার নিদর্শন, কথ্য ভাষার নয়। কিন্তু এর আগেও যে বাংলা ভাষার নিদর্শন ছিল, তা-ই খুঁজে এনেছেন এই গবেষকেরা। দেখা যাচ্ছে, সুদূর চিনে সংকলিত একটি চিনা-সংস্কৃত অভিধানে বাংলা শব্দ রয়েছে অন্তত ৫০টির বেশি। এর সংকলক লি-এনের মৃত্যু হয় ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ, অষ্টম শতকে রচিত অন্য দুটি ভাষার অভিধানে যদি বাংলা ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হয় বাংলা ভাষা ইতিমধ্যেই মান্যতা পেয়েছে, এবং তাও ৩০০-৪০০ বছর পূর্বেই।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক, অর্থাৎ আজ থেকে ২৩০০ বছরেরও আগে আরও একটি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বাংলা ভাষার। আক্ষরিক অর্থেই পাথুরে প্রমাণ। অধুনা বাংলাদেশ, আগেকার অবিভক্ত বঙ্গের মহাস্থানগড়ে যে শিলালিপি খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা, সেখানেও পাওয়া যাচ্ছে ‘বঙ্গ’ শব্দটি।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই অশোকের গিরনার শিলালিপিতেও ‘দ্বাদশ’ শব্দে বর্গীয় ব-এর খোঁজ মিলছে। ব্রাহ্মী লিপিতে বর্গীয় ও অন্তঃস্থ ব আলাদা। একমাত্র বাংলা ছাড়া কোনও ভাষাতেই অন্তঃস্থ ব-এর স্থানে বর্গীয় ব ব্যবহার করা হয় না।
এমনই নানা তথ্যপ্রমাণ খুঁড়ে এনে গবেষকেরা বাংলা ভাষার যে প্রাচীনত্বের প্রমাণ দিলেন, তার দরুনই অবশেষে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল বাংলা। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা, ভালোবাসার ভাষা, কিন্তু সে কাজের ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি বলেই পুঁজির দৌড়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, এমন অভিযোগ বারেবারেই শোনা গিয়েছে। আশা করা যায়, সেই আক্ষেপ-অভিযোগের মিছিলে আপাতত বাঁধ দেবে এই স্বীকৃতি। কেন-না, এই স্বীকৃতির দরুন কেন্দ্রীয় উদ্যোগেই বাংলা ভাষা চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে একটি ‘সেন্টার ফর এক্সেলেন্স’। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণার জন্য চেয়ার পোস্ট, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা চর্চা, এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষকদের জন্য বছরে দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেবে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। সর্বোপরি, বিশ্বায়নের দুনিয়ায় বাংলা ভাষা দীর্ঘদিন ধরে যে বিপুল অবহেলা কুড়িয়ে এসেছে, তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে এই স্বীকৃতি অতীত গৌরব নিয়ে সচেতন করবে বাঙালিকে, এমন আশা করাই যায়।
আশা করা যায়, যে ভাষিক হীনম্মন্যতা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে, এই গৌরবের হাত ধরে আমরা হয়তো সেই গ্লানি মুছে মাতৃভাষাকে আরও একটু ভালোবাসতে শিখব। বাংলা ভাষা বলেই ‘যা ইচ্ছে’ লেখা কিংবা ‘যা ইচ্ছে’ বলা চলে, এই ঔদ্ধত্যেও হয়তো লাগাম টানতে শিখব। একুশে ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত তারিখ ছাড়িয়েও হয়তো ফিরে তাকাব মাতৃভাষার পানে।
মাতৃপক্ষে মাতৃভাষার গায়ে এসে পড়ল ধ্রুপদী আলো, বাঙালির পক্ষে এর থেকে ভালো উৎসব আর কী!