বছর ঘোরে। প্রেমের রং রূপ পালটে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যেমনটা গিয়েছে বাঙালিরও। কিন্তু প্রেমের মন পালটেছে কতখানি? নতুন বছরে বাঙালির প্রেমের হালচাল খতিয়ে দেখলেন রিংকা চক্রবর্তী।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভালোবাসা কি চিরকাল বেঁচে থাকে? না কি এর ক্ষয় অনিবার্য? ভালোবাসা যদি এতই মধুর হয়, তবে এত কীসের যন্ত্রণা? সত্যিকারের ভালোবাসার মৃত্যু নেই, বেঁচে থাকে মুহূর্ত আর স্মৃতিতে। তাহলে যেগুলো পরিণতি পায়, সেগুলো ভালোবাসা নয়? কোনটা সত্যি আর কোনটা নয়, সব গুলিয়ে যায়। ‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়বে না।’ তারপরেই সতর্কীকরণ– ‘গোলেমালে গোলেমালে পিরিত কোরো না।’ মস্তিষ্ক ঘেঁটে দেওয়ার এ কেমন প্রচেষ্টা? পাড়ার মিঠিদি আজীবন একা রয়ে গেল। কানাঘুষো শোনা যায়, পাশের পাড়ার স্বল্প রোজগেরে, বিশুদাকে মিঠিদির বাড়ির কেউ মেনে নেয়নি। বিশুদার অপরাধ, সে কবিতা লিখত। পাকা চাকরির বন্দোবস্ত ছিল না। আগের জমানায় এসব খুব হত। ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে আর কোনও দিন ঘর বাঁধত না কেউ। পুরুষমানুষের পকেট দেখে বিচার হয় এখনও তার মান। দিন বদলালেও কিছু মানুষের মানসিকতা একই আছে! প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মঘাতী হওয়ার নজির অহরহ। ‘ভালোবাসা এক খেপাটে জুয়ার নেশা, ভালোবাসা সব বাজি ধরা নির্বোধ…’– আচ্ছা প্রেমের জন্য ঠিক কতদূর যেতে পারি আমরা? সবকিছু ত্যাগ করে যে ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথ তাকেই ‘প্রেম’ বলেছেন। প্রেম হবে নিঃস্বার্থ। কিন্তু কোনও সম্পর্কই কি স্বার্থের ঊর্ধ্বে? কোথাও একটা চোরা বোঝাপড়া কি থেকে যায় না? প্রেমে অন্ধ হয়ে ব্রিটেনের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ত্যাগ করেছিলেন তাঁর সাধের রাজ্য। রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাধারণ নারী ওয়ালিস সিম্পসনের অসম প্রেম কাঁপিয়ে দিয়েছিল প্রায় ১২০০ বছরের পুরনো ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভিত। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নাকি তাঁর স্ত্রী জোসেফিনকে লিখেছিলেন প্রায় ৭৫ হাজার চিঠি। তাঁর মতো তুখোড় যোদ্ধার মনেও যে প্রেমের এমন ধারাপাত, তার প্রতীক বহন করে চিঠিগুলো। প্রেমের জন্যই টিকে আছে এই পৃথিবী। এরকম অনেক ভালোবাসা দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
সময় পালটাচ্ছে। প্রেমের ধরনও বদলেছে। সে যুগের প্রেম আর এ যুগের প্রেমের ধরন-ধারণে এসেছে বিরাট ফারাক। কিন্তু ফারাক যতই থাকুক, প্রেমে কি ফারাক আছে? মানুষ যতটা ভালোবাসা দেখায়, আসলে ততটাই ভালোবাসে কি? ‘রিল’ সর্বস্ব দুনিয়ায় ভালোবাসার দেখনদারিটাই এখন আসল বলে মনে হয়। আবেগের প্রতিটি মুহূর্ত বন্দি হয় মুঠোফোনে। প্রেম এখন অনেক বেশি সোচ্চার। প্রেমের কথা না জানালেই বরং ‘খবর’ হয়ে যায়! নিয়ত ভাঙাগড়ার ‘খেলা’ চলছে যেমন, তাতে মনে হয়, কাউকে আর কষ্ট করে প্রেমের জন্য মরে গিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে না, প্রেমই একদিন মরে গিয়ে মানবজাতির জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে!
অস্থির পৃথিবীর মতো সম্পর্কগুলোও যেন এখন বড় অস্থির। সময়ই হয়তো ভালবাসার ধরন নির্ধারণ করে। প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রেমটাও এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আগেকার দিনে প্রেমের জন্য যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি। ডাকপিয়ন হিসেবে থাকত এলাকারই ছোট ছোট ভাই কিংবা বোন। কখনও বন্ধুরা। আবার চিঠি বয়ে আনতে আনতে তার সঙ্গেই প্রেম হয়ে গিয়েছে, এমন ঘটনাও আছে। চিঠির প্রত্যাশায় থাকত দীর্ঘ অপেক্ষা। কিন্তু এখন কে আর অপেক্ষা করতে চায়? অনুভূতিগুলোর মেয়াদ স্বল্প। প্রিয় মানুষের পাঠানো মেসেজগুলোই খুঁটিয়ে পড়ার সময় নেই! সোশাল মিডিয়ায় রিলেশনশিপ স্টেটাস আপডেটের ওপরই প্রেমের আয়ুষ্কাল নির্ভর করে মনে হয়। বিয়ের আগে প্রেম-পর্ব চলার সময় যে ছিল অনেক বেশি রোমান্টিক, বিয়ের পরে তাকেই কি পানসে মনে হয়? দুজনের মধ্যে ভাঙন ধরাচ্ছে কি অন্য সম্পর্ক, নাকি ভালোবাসা শুরুর আগেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে?
এই গতির যুগে প্রেমও এতটাই গতিশীল হয়ে গিয়েছে যে, প্রেমিক-প্রেমিকারা এখন আর দৌড়েও প্রেমের নাগাল পায় না। প্রযুক্তির উৎকর্ষ দিন দিন যতই বাড়ুক না কেন, সত্যিকারের প্রেম ও অনুভূতিগুলো পড়ে রইবে সেই লাল-নীল রঙা খামের ভেতরেই।
ভালোবাসার বিষয়টা এখন অনেক বেশি বাণিজ্যিক। তাই না ভালবাসার দিন ঘিরে এত মাতামাতি, বিক্রিবাটা। যে প্রেম হত একসময়ে গোপনে, তার উদ্যাপন হয় এখন ঘটা করে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনের মানুষের সংজ্ঞাগুলো কেমন যেন বদলে গিয়েছে। প্রেম এখন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক। ‘সুবিধাজনক প্রেম’-ও বলা যায়। আমরা সবাই সামনের দিকে ছুটে চলেছি। সেই চলার পথে প্রতি বাঁকে কেউ না কেউ হয়তো অপেক্ষা করে। তখনই মনের মানুষও যায় বদলে। ‘Change is the only constant.’ এতসব ভালো-মন্দের মধ্যেও অসংখ্য প্রকৃত ভালোবাসা বেঁচে আছে। আর আছে বলেই পৃথিবীটা এখনও এত সুন্দর। যার সঙ্গে হয় প্রেমের প্রথম হাতেখড়ি, তার সঙ্গে নাকি সংসার পাতা হয় না। কিন্তু মন থেকে মুছে যায় কি সেই ভালোবাসার পরশ?
:আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা : ময়দানি তাঁবুতেও ফিরুক বাংলা
বাঙালির হাল-খাতা : সাহিত্য আর আড্ডার সুতোয় বাঁধা পয়লা বৈশাখ
বাঙালির হাল-খাতা : হালখাতার সঙ্গে বাঙালির বছর শুরুর পুজোপাঠ
বাঙালির হাল-খাতা: স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়েই পাত বাড়ে বাঙালি
বাঙালির হাল-খাতা : বাঙালির হাল-খাতা : বঙ্গনেতাদের কথায় ফিরুক সৌজন্য