মহাকাব্য সবসময়েই রামের কথা বলেছে। কিন্তু তার বিপরীত প্রেক্ষিত থেকে, রাবণের কথাকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। উচ্চবর্ণ বা ক্ষমতাবানের যে একাধিপত্য সমাজে জারি থাকে, মেঘনাদবধ কাব্য সেই সংস্কৃতির এক পালটা বয়ান। সব মতকে এক ছাঁচে বেঁধে ফেলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও বটে। দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে মধুসূদনের সেই দ্রোহকে ফিরে দেখলেন হিন্দোল ভট্টাচার্য।
নবজাগরণের সময় বাংলার মনীষায় যে বিপ্লব এসেছিল, তা নানারকম ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার শিল্প-সাহিত্যে। সবথেকে বড়ো কথা, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার যে সীমাবদ্ধতা, তা তাঁরা সম্পূর্ণভাবেই বুঝতে পারছিলেন। এ প্রসঙ্গে শুধু আমরা সে সময় প্রচুর মেধাসম্পন্ন বাঙালিকেই দেখি, যাঁরা সমাজব্যবস্থার একপেশে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই নবজাগৃতির মধ্যেও একধরনের নিরাপদ অঞ্চল ছিল, আর তা হল, প্রগতিশীলতার প্রবহমানতায় যতটা সম্ভব, ততটাই প্রগতিশীল হব। তার বেশি হতে পারব না। এই কিছুটা প্রগতিশীল, আর বাকিটা আপসের মধ্যে একপ্রকার জগাখিচুড়ি আধুনিকতা আছে। আধুনিকও হলাম এবং সামন্ততান্ত্রিক অবশেষগুলিকেও বজায় রাখলাম। রক্ষণশীলও রইলাম এবং আধুনিক হিসেবে চিহ্নিতও হওয়া গেল। সামগ্রিক ভাবে কিছু ভাঙা হল না, কিন্তু বুঝলাম যদি ভাঙতে চাওয়া হয়, তাহলে ভাঙা যায়। ভেঙে গড়াও যায়। কিন্তু সেই ঝুঁকি কে নেবে? এখানেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলা যায় অন্যান্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।
ইউরোপীয় মিথ, কাব্য ও দর্শনের নির্যাসের সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় পুরাণ, কাব্য, মিথ এবং দর্শনের রূপ। আঙ্গিকটুকু তিনি নিয়েছেন ইউরোপীয় এপিক এবং কাব্য থেকে, কাঠামোটুকু নিয়েছেন কাব্যের ছন্দবিন্যাস, ফর্ম এবং অলংকারগুলি থেকে। কিন্তু, সবকিছুকে মিশিয়ে তিনি রচনা করেছেন এক বাঙালি কাব্য। পাশ্চাত্য তাঁর ভাবনার ছত্রে ছত্রে মিশে আছে স্রেফ আঙ্গিক হিসেবে। ভারতীয় পুরাণ এবং পাশ্চাত্য আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গির যে মিথস্ক্রিয়া রচনা করলেন তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, তা যেন এক প্রতীক। যেন পথ দেখাল আমাদের। অনেকটা টি এস এলিয়ট যেমন স্যাক্রেড উডে বলেছিলেন ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্টের কথা, সেভাবেই, শিকড় এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি এমনভাবে মেলালেন, যাতে, শিকড়কেও নতুনভাবে দেখার চোখ ফুটল আমাদের। মাইকেল তেমনভাবে কোনও টেস্টামেন্ট বা কাব্যভাবনা লেখেননি। কোলরিজের মতো নতুন কোনও তাত্ত্বিক পরিসরও তৈরি করেননি। কিন্তু তাঁর কাব্যগুলি নিজেরাই এক একটি টেস্টামেন্ট। অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার কবিতায় যে মুক্তি এনে দিল, তা যেন কাঠামোগত ভাবে এত কালের ঘন কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করা। অন্ত্যমিলের পয়ার ছন্দ থেকে কবিতাকে বের করে এনে ছন্দকেও একটা মুক্তি দিলেন তিনি।
‘চতুরঙ্গে রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা/ এ বিষম জ্বালা যদি পারি রে ভুলিতে’।
একদিকে মিথিকাল প্যারালালিজম অর্থাৎ পুরাণের পাশাপাশি এমন একটা ন্যারেটিভ তৈরি করছেন, যা, আবার, আমাদের পরিচিত টেক্সট নয়। অর্থাৎ, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেই তিনি বিনির্মাণের মতো একটি কাজ করছেন। একটি মহাকাব্যকে আসলে ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির মতো করে ব্যবহার করে, তিনি রামায়ণের একটি অপর পাঠ লিখছেন। খেয়াল করে দেখুন, এই কাজটি তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে, কতটা বৈপ্লবিক কাজ, ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে, একটি মহাকাব্যের অন্য একটি পাঠকে আরেকটি মহাকাব্যের নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি ভেঙে দিলেন শাশ্বত বলে খ্যাত রামায়ণ নামক মহাকাব্যের ‘সত্য’ নামক বিশ্বাসকে। অর্থাৎ রামায়ণ একটি টেক্সট। যেখানে নায়কের বিপরীতে যাঁরা আছে, তাঁদের প্রেক্ষিত থেকেও দেখা যায় সেই টেক্সটটিকে। এই যে উলটে দেওয়া, হতে পারে, তা ইউরোপের ভাবনা আশ্রিত; কিন্তু তাকে যেভাবে, যে অলংকারে, যেরকম পৌরাণিক বিন্যাসে, কাব্যের আবহে তিনি রচনা করলেন, তা নিজেই এক মহাকাব্য হয়ে উঠল। সত্যের বিপ্রতীপে আরেকটি সত্য তো এইভাবেই তৈরি হয়। কারণ দুটিই নির্মাণ। ভাবুন, আজকের ভারতবর্ষে যদি মাইকেল এই কাজটি করতেন তবে হয়তো তাঁকে আক্রমণ করত গেরুয়া শিবির। ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে থাকত। পুড়ত মহাকাব্য।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: শস্যের রূপকে রাম-সীতা ভাই-বোন, রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য
যে কাব্যভাষা এবং তার নির্মাণের জন্য যে কাব্যিক ছন্দকাঠামো মধুসূদন তৈরি করেছিলেন, তা যেমন কাব্যে মুক্তি এনে দিল, তেমন আমাদের ভাবনাতেও এনে দিল একপ্রকার মুক্তি। তার মানে, আমাদের সমস্ত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক টেক্সটকেই আমরা সমান্তরাল একটি টেক্সটে দেখতে পারি। কে বলতে পারে, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ যে কর্ণকুন্তীসংবাদ বা গান্ধারীর আবেদন লিখলেন, সেগুলির বীজ লুকিয়ে আছে মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যেই। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, কাব্যের এই বিশেষ ধারায়, মেঘনাদবধ কাব্য অনেক বেশি সূক্ষ্ম, তার নির্মাণ অনেক সুন্দর, অনেক গভীর। তিনি বাঙালিদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র বাঙালি, যাঁকে অন্যান্য বাঙালিদের মতো করে ভাবাই উচিত নয়। অবশ্য সেই যুগটাও আশ্চর্য। একই সময়ে তিনি সঙ্গে পাচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো একজনকে, যিনি নিজেও সমাজের গতানুগতিকতার বিপরীতে, প্রবহমানতার উলটোদিকেই হেঁটেছেন এক বৃহত্তর স্বপ্নকে ধারণ করার জন্য। একদিকে বদ্ধ জলাশয়ের মতো সমাজটাকে সংস্কার করা বিদ্যাসাগরের কাছে যেমন ছিল এক যুদ্ধের মতো, তেমনই, বাংলা কবিতাকে খোলনলচে আধুনিক করে তোলার কাজটিও ছিল মাইকেলের কাছে সমান দুরূহ। আর এই দুটি কাজই তাঁরা দুজন যা চলছে, তাকে মেনে নিয়ে, করতে পারতেন না। নতুন কিছু করলে যে তোমার চারপাশ তোমার কাজকে স্বীকৃতি নাও দিতে পারে, তখন একজন কবি বা শিল্পী বা সংস্কারকের কাছে একপ্রকার যুদ্ধই শুরু হয়ে যায় জীবনে, এ বিষয়ে নিশ্চয় কারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মধুসূদন সমগ্র জীবনটাকেই বাজি রাখলেন কবিতার জন্য। নিজের ভাবনার মধ্যে যে যুক্তি তক্কো গপ্পের ভুবন, তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও সমান ভাবে প্রবাহিত হল। ফলে, সে যুগের সৌভাগ্যবান মানুষ স্বচক্ষে দেখতে পেলেন কবিতার এক রক্তমাংসময় অস্তিত্বকে।
খেয়াল করে দেখুন, আমরা যদি রামায়ণের আর্কিটাইপ চিত্রটিকে দেখি, রাম ও সীতা বসে আছেন এবং তাঁদের পায়ের তলায় রয়েছেন হনুমান, তাহলেই আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, দেবতা ও ভক্তের আকুতির এক দর্শনের ছদ্মবেশে এটি আসলে অনার্যদের চিরকাল পায়ের তলায় রাখার এক রূপ। এ কথা তো অনস্বীকার্য, যে রামায়ণের মূল যুদ্ধটি হয়েছিল এক দল অনার্যের সঙ্গে আরেক দল অনার্যের। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল রাম-লক্ষ্মণের মতো আর্য আধিপত্যবাদী শাসকেরা। এবার যদি আমরা ফিরে আসি মাইকেলের সময়কালের বাংলায়, তাহলে দেখব, সেই বাংলা উচ্চবর্ণের বাঙালিদের আধিপত্যবাদে দিশেহারা। কুসংস্কারে, ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক নানান অনুশাসনে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। এ দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব ছিল না মাইকেলের পক্ষে। হয়তো অনেকটা এ কারণেও তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট বা ওভিদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও, তিনি তাঁর নিজস্ব মহাকাব্যের মূল নায়ক তাকেই করে দিলেন, রামায়ণে যিনি নায়ক নন, খলনায়ক। কারণ তিনি সমাজের এই উচ্চবর্ণ তথা শাসকগোষ্ঠীর যে সমাজ বিভাজন তাকে উলটে দিতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের যে পুরাণ বা মহাকাব্যগুলি, তাতে, অনার্য এবং দ্রাবিড়দের পদানত করে রাখার যে আধিপত্যবাদ, তা-ই রূপকাত্মক এক টেক্সটের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মাইকেল-ই প্রথম, যিনি এই প্রবহমান সংস্কৃতির উলটো পথে হাঁটা শুরু করলেন। এমনকি, এক্ষেত্রে, তিনি মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টের চেয়েও আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। সেখানে স্যাটানের স্পিচ আছে, স্যাটান সেখানে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং তার জন্য ঘটে চলা অন্যায় সম্পর্কে সে যুক্তিসংগত ভাবেই বিদ্রোহী। কিন্তু সেখানেও এক বাইনারি আছে। এ পক্ষ ও পক্ষ। অথচ মাইকেলের মহাকাব্যের প্রেক্ষিত একেবারেই রাবণ, মেঘনাদ এবং রামের উলটোদিক থেকে লেখা। পুরাণের সমান্তরালে তিনি যে এক আধুনিক বয়ান তুলে ধরলেন, তা যেন আমাদের পরবর্তীকালের সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের কথা মনে পড়িয়ে দিল।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: রায়সাহেবের রামদর্শন– থাকেন ‘জটায়ু’, দুষ্টু লোকের পাশেই চলে রামের ভজন
সময়ের থেকে একজন কবি কতটা এগিয়ে থাকলে, তবে সময়কে এভাবে দেখা যায়! কিন্তু এ কথা ঠিক, নবজাগরণের সময় সমাজের প্রতিষ্ঠিত যে ব্যবস্থা, তা নিয়ে মুষ্টিমেয় মেধাবী কয়েকজন মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল বলেই একদিকে উঠে এসেছিল ব্রাহ্ম ধর্ম, অন্যদিকে মাইকেলের বিদ্রোহ ও সৃষ্টি, আবার অন্যদিকে একের পর এক সমাজসংস্কার। সামগ্রিকভাবেই মাইকেলের এই মহাকাব্যিক বিপ্রতীপ অবস্থান বাংলা কাব্যধারাকেও অনেক বেশি মাত্রায় প্রগতিশীল করে দিয়ে গেছে।
হয়তো এখন তিনি বেঁচে থেকে এই মেঘনাদবধ কাব্যের মতো এই মহাকাব্যিক সন্দর্ভ তৈরি করতে পারতেন না। লেখার অপরাধে তাঁকেও হত্যা করত হয়তো ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। কারণ সত্যি সত্যি বুঝতে পারলে, মেঘনাদবধ কাব্য এখনও প্রাসঙ্গিক এবং উচ্চবর্ণের মৌলবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক অবরোধ।