হিন্দু বাঙালির রক্ষণশীল ঘরের গৃহবধূ তিনি। মেয়েদের জন্য সেখানে পায়ে পায়ে লক্ষ্মণরেখা টানা। সেই ঘোমটা-টানা অন্তঃপুর থেকে এমন কাহিনি লিখে ফেলা দুঃসাহস ছাড়া আর কী! সমাজ মেয়েদের যে অবহেলায় ফেলে রাখতে চেয়েছে, নিজেকে বিপুল সৃজনের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন শৈলবালা ঘোষজায়া।
সাম্প্রতিক কালে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেমের ঘটনা ঘটলে তাকে এককথায় দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাভ জিহাদ বলে। এই সম্পর্ককে স্রেফ মুসলিম পুরুষটির ধর্মান্তরণের চাল বলেই গর্জে উঠছেন হিন্দুত্ববাদীরা। অথচ, একশো বছরেরও আগে এক হিন্দু বিধবার সঙ্গে এক মুসলিম যুবকের প্রেম নিয়ে উপন্যাস লিখতে দ্বিধা করেননি শৈলবালা ঘোষজায়া। হিন্দু বাঙালির রক্ষণশীল ঘরের গৃহবধূ তিনি। মেয়েদের জন্য সেখানে পায়ে পায়ে লক্ষ্মণরেখা টানা। সেই ঘোমটা-টানা অন্তঃপুর থেকে এমন কাহিনি লিখে ফেলা দুঃসাহস ছাড়া আর কী! সেই সাহস দেখাতে ভয় পাননি এই লেখিকা। আর ‘শেখ আন্দু’ নামের এই উপন্যাসের হাত ধরেই বাংলার পাঠকসমাজে দৃপ্ত আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তাঁর।
আরও শুনুন:
হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষে মনে থাকুক ‘অবরোধবাসিনী’দের হয়ে বেগম রোকেয়ার লড়াই
দৃপ্তই বটে। শৈলবালা নিজের পরিচয় জানাতেন শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়া বলে। যেখানে বিবাহিতা মেয়েদের পরিচয় দেবী কিংবা দাসী পদবিতেই ফুরিয়ে যায়, সেখানে নামের আগে ‘শ্রী’ ব্যবহার? একে সাহস ছাড়া কী-ই বা বলা যায়! পরিবার, সমাজ থেকে বিপুল সমর্থন মিলবে না সে তো বলাই বাহুল্য। তেরো বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর স্বামী নরেন্দ্রমোহন ঘোষ অবশ্য পাশে ছিলেন অনেকখানিই। লেখালিখির জন্য উৎসাহ জোগাতেন স্ত্রীকে। সতেরো বছর বয়সেই ‘মোহের প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক লিখেছিলেন শৈলবালা। তবে তা প্রকাশ পায় পরে। তার আগেই প্রবাসী পত্রিকায় ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘শেখ আন্দু’। এক হিন্দু বিধবা মেয়ের সঙ্গে দরিদ্র মুসলমান ড্রাইভারের প্রেমকাহিনি লিখলেন শৈলবালা। রক্ষণশীল ধ্যানধারণাকে নস্যাৎ করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ‘উন্নতির হাত-পা নেই, তাকে নিজের হাতে গড়ে নিতে হয়…।’ ১৯১৭ সালে এই উপন্যাস দু’মলাটে প্রকাশ পেল, আর ১৯২১-এ দ্বিতীয় সংস্করণ। সেসময়ের ছাপার হিসেব দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, রীতিমতো পাঠকপ্রিয়তা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন নবাগতা লেখিকা।
কিন্তু উলটোদিকে জমছিল দুর্ভাগ্য। ‘শেখ আন্দু’ প্রকাশের বছর দুই কাটতে পারল না, উন্মাদ হয়ে গেলেন স্বামী। তাঁর চিকিৎসা আর সেবাযত্নের জন্যে দশটা বছর ফুরিয়ে গেল, কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হল না। মধ্য-তিরিশের নিঃসন্তান বিধবা শৈলবালা আঁকড়ে ধরলেন লেখাকেই। যদিও একান্নবর্তী শ্বশুরবাড়িতে সেই চর্চাকে দেখা হত স্পর্ধা হিসেবেই। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘এ দেশের মেয়েকে বড় লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়…।’ কিন্তু ব্যক্তিজীবনের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই সাহিত্যের রসদ সংগ্রহ করে চলেছিলেন শৈলবালা। একইসঙ্গে, তিনি যে বিশ্বাস করতেন বদল আনতে হয় নিজের হাতেই। তাই মহিলাদের উপযুক্ত সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার কথাও ভাবছিলেন তিনি। সেই কারণে নারীশিক্ষা, নারীদের স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে শামিল হয়েছিলেন হরেক কর্মকাণ্ডে।
আরও শুনুন:
‘মেয়েলি লেখিকা’ তকমা নিয়েই আশাপূর্ণা তুলে ধরেছিলেন রুদ্ধস্বরের কথকতা
উপন্যাস, গল্প, আত্মকথা, শিশুসাহিত্য, ঐতিহাসিক কাহিনি, নাটক- কী না লিখেছেন শৈলবালা। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের একেবারে প্রথম যুগে যে মেয়েরা কলম ধরেছিলেন, তিনিও তাঁদের মধ্যে একজন। সমাজ মেয়েদের যে অবহেলায় ফেলে রাখতে চেয়েছে, নিজেকে বিপুল সৃজনের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তা থেকে উত্তরণ চেয়েছিলেন শৈলবালা। যদিও সময় পেরিয়েছে, একসময়ের প্রবল জনপ্রিয়তা হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির গর্ভে। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের অর্ধেক আকাশ দাবি করার সেই দিনগুলিতে শৈলবালা ঘোষজায়াও ছিলেন প্রথম সারির সৈনিক, সে কথা ভোলার জো নেই।