বাংলা কোন শব্দে কোন বানান লেখা হবে, তা নিয়ে মাঝে মাঝেই বিতর্ক উসকে ওঠে। সোশাল মিডিয়ায় মতামতের ঝড় বয়ে যায়। অথচ প্রায় শ-খানেক বছর আগেই এই সমস্যার কথা ভেবেছিলেন এক বাঙালি, আর উদ্যোগও নিয়েছিলেন সেই সমস্যা সমাধানের জন্য। তিনি রাজশেখর বসু। বাংলা সাহিত্যের পাঠক যাঁকে চিনেছে পরশুরাম নামেই। যে অভিধান সকলের হাতে হাতে ঘুরবে, আম মানুষের কাছে যা সুলভ ও সহজে ব্যবহার্য, বাংলা ভাষায় তেমন অভিধান রচনার পথ খুলে দিয়েছিলেন তিনিই।
বেঙ্গল কেমিক্যালের ল্যাবে যতটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন রাজশেখর বসু, ভূশণ্ডীর মাঠেও তাঁর আনাগোনা তেমনই অবাধ। সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন, আবার তাঁর ভাষাচর্চা থেকেই গড়ে ওঠে গোটা অভিধান। যা দেখে খোদ রবীন্দ্রনাথও স্বীকৃতি দেন, “এতদিন পরে বাংলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল।” বিজ্ঞানচর্চার চোখ, সাহিত্যিক মনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল বলেই কি না কে জানে, ভাষার সমস্যাগুলি দূর করার তাগিদ ছিল রাজশেখরের। ভাষাও তাঁর কাছে হয়তো হয়ে উঠেছিল আরেকরকম গবেষণাগার। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আসলে আমি আধা মিস্ত্রি, আধা কেরানি। অভিধান তৈরি আর পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রির কাজ, রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ কেরানির কাজ।”
আরও শুনুন:
সত্যজিতের মতের বিপক্ষে যেতেও দ্বিধা করেননি সন্দেশ-এর ‘বড় সম্পাদিকা’
সত্যি বলতে, রসায়নের সঙ্গে রসসাহিত্যের যোগ তো আপাতদৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। রসায়নবিদ রাজশেখর বসুর জীবনের প্রায় প্রথমার্ধ জুড়ে বিজ্ঞাপন আর ক্যাটালগ ছাড়া এমন কিছু লেখার দরকারই পড়েনি, যা ছাপা হবে। অথচ ৪২ বছর বয়সে যখন তাঁর প্রথম লেখাটি ছাপা হল, সেই ‘শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ পড়ে চমকে গেলেন বাঙালি পাঠকেরা। মনে রাখতে হবে, তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্বদেশি সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালের কর্মী। সেইজন্যেই হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে রাতারাতি গড়ে ওঠা অসাধু সংস্থাগুলি নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে চেয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধ আর পুঁজির অসাধু যোগের কথা তুলে এনেছিলেন ‘গামানুষ জাতির কথা’-তেও। কিন্তু সেসব তো লেখার কথা। যে ভাষা তৈরি হয়ে আছে, তাকে ব্যবহার করে লেখা। এর পাশাপাশি ভাষায় কোনও অভিনব নির্মাণ রেখে যাওয়া যায় কি না, তা নিয়েও তিনি মাথা ঘামিয়েছিলেন। আর তাই, তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছিল ‘চলন্তিকা’।
আসলে, যে যার মতো বানান লিখে ফেলছেন, এ প্রবণতা নতুন নয়। তাই বাংলা বানানের সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্য রাজশেখরকে অনুরোধ করেছিলেন গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহাকে সঙ্গে নিয়ে এই বিপুল কাজে হাত দেন রাজশেখর বসু। যে সমস্ত শব্দের একাধিক বানান আছে, তার তালিকা তৈরি করেন। বানান নির্বাচনের মতামত চেয়ে তালিকা পাঠিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, যোগেশ বিদ্যানিধি, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে। অবশেষে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘চলন্তিকা’। প্রথম মুদ্রণে ছিল ২৬০০০ শব্দের তালিকা, পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০০০-এ।
আরও শুনুন:
‘যাঃ’ মানেই ‘হ্যাঁ’! প্রেমে ডুবে মরা বাঙালির আজব কিস্সা
আর এই অভিধানের সূত্রেই ভাষাচর্চার আরও একটি দিক নিয়ে চিন্তা করেছিলেন রাজশেখর বসু। অনুবাদের সূত্রে তিনি জানতেন, অন্য ভাষার শব্দের বাংলা পরিভাষা পাওয়া সবসময় সহজ নয়। তিনিই বলেছিলেন, ‘দি পোলিস ওয়্যার পেট্রলিং দি রোডস’-এর বাংলা করতে গিয়ে কেউ নাকি এমনও বলেছিলেন, ‘পুলিশ রাস্তায় পেট্রল ছিটাইতেছিল।’ পুলিশের পেট্রল বা টহলদারি-র মানেই বদলে যায় এহেন অনুবাদে। এই কারণেই বাংলা পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চেয়েছিলেন রাজশেখর বসু। ‘চলন্তিকা’র পরিশিষ্ট অংশে বিষয় অনুযায়ী প্রচুর পরিভাষা সাজিয়েছিলেন তিনি। বেঙ্গল কেমিক্যালে কাজ করার সময়েও রোজকারের ব্যবহারের নানা জিনিসের বাংলা নাম দিতেন তিনি, ইংরেজি ভাষার চলতি শব্দ ব্যবহার করেই কাজ সেরে ফেলায় তাঁর আপত্তি ছিল। তিনিই ‘কীটনাশক পদার্থ’-এর নাম দেন ‘মারকীট’, ‘এসেন্স’ হল ‘কনসেন্ট’, ‘ডায়াবেটিসের ওষুধ’ হল ‘ডায়াবিনল’, ‘আয়োডিন প্রলেপ বা মলম’-এর নাম দিলেন ‘আইডোলেপ’। এগুলি যখন বিজ্ঞাপন হিসেবে পত্রিকার পাতায় বেরোত, তখন সেই বয়ানও নিজে হাতে লিখতেন রাজশেখর। অফিসের খাতায় সইও করতেন বাংলায়। ‘ডেসপ্যাচ স্লিপ’কে লিখতেন ‘যা-পত্র’, আবার ‘ভিজিটিং অর্ডার স্লিপ’কে ‘দ্র. পত্র’ বলেই উল্লেখ করতেন তিনি। তিনি বুঝেছিলেন, কেবল অভিধানের পাতায় শব্দ লিখে রাখলেই কাজ ফুরোয় না। প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগ ঘটালে তবেই নতুন শব্দ বেঁচে থাকবে, আর তার ফলে জোর বাড়বে ভাষারও। সেই দায়িত্ব তাত্ত্বিক লেখকদের চেয়েও সাংবাদিকদের উপর বেশি করে বর্তায়, এমনই ছিল তাঁর মত। কেন-না, খবরের কাগজের সঙ্গে আমজনতার যোগাযোগ অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ বই পড়ে যত ভাষা শেখে, খবরের কাগজ পড়ে তার চেয়ে আরও দ্রুত এবং সহজে ভাষা শেখে বলেই মনে করতেন রাজশেখর।
আসলে পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও মাতৃভাষার প্রতি সবারই একরকম কর্তব্য থাকে, এ কথায় বিশ্বাস ছিল রাজশেখর বসুর। সারাজীবন ধরে নিজের মতো করেই সেই কর্তব্য পালন করে গিয়েছিলেন এই রসায়নবিদ।