আমাদের পুজো শেষ, ওঁদের ঘরে ফেরা শুরু। পঞ্চমীতে পুরুষ-শূন্য হয়ে যায় এই বাংলার একাধিক গ্রাম। যেখানকার অধিকাংশ পুরুষ বংশ পরম্পরায় ঢাকি। ওঁরা ঘরে ফেরেন দ্বাদশীতে। দ্বাদশীতেই ওঁদের উৎসবের শুরু। কারণ পকেটে তখন খুচরো আলোর রোজগার!
‘বিষাদ ঠাকুর’কে কেমন দেখতে? অনেকের মতে, অনেকটা পড়ে আসা বিকেলের আলোর মতো, যা লেগে থাকে ঢাকির ছেলের চোখে-মুখে। ওর মলিন কাপড়েও দুঃখ দুঃখ গন্ধ! আমরা যখন নতুন পোশাকে, বচ্ছরকার আনন্দে মাতোয়ারা, তখন ঢাকি ও তাঁর কিশোর ছেলেটা আয়-উপায়ে ব্যতিব্যস্ত। অবশ্য এতসব দেখার সময় থাকে না আমাদের। তবু, কবি বলেছেন, ‘সে তুমি শ্রমিক কিংবা তা ধিন ধিনা, পেটে চাই খাবার নয়তো দিন চলে না, দিন চলে না’। তার মানে কি একজন ঢাকির জীবনে সারাক্ষণই সন্ধে বিরাজ করে? আলোর রোজগার নেই মোটেই? অবশ্যই আছে। এই যে পুজোর চারদিনে রোজগার হল। এইবারে দ্বাদশীতে মানিব্যাগে খুচরো আলো নিয়ে ঘরে ফিরবেন শহরের অসংখ্য মণ্ডপ ফেরত ঢাকির দল।
আরও শুনুন: দশমীতে যুদ্ধ শুরু, দ্বাদশীতে ‘রাবণ কাটা’ উৎসব হয় এই বাংলাতেই
বর্ধমানের খন্ডঘোষের কৈয়ড় গ্রামের কথাই যেমন বলা যায়। ৮০ ঘর রুইদাস পরিবার রয়েছেন এই গ্রামে। গোটা গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ সারা বছর এটাসেটা করে সংসার চালান। আর পুজোর সময়ে ঢাক বাজিয়ে কিছু বাড়তি রোজগার। বাপ-কাকা-জ্যাঠার পিছু পিছু কাঁসি হাতে শহরে যায় কিশোর সন্তানটিও। ফলে মহালয়ার পর থেকেই বদলে যায় গোটা কৈয়ড়। যেহেতু গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ গ্রাম ছাড়েন এই সময় থেকে। পঞ্চমীতে একেবারে পুরুষ-শূন্য হয়ে যায় গ্রাম। দ্বাদশী অবধি অপেক্ষা করেন পরিবারের মা-মেয়ে-বউরা। কারণ দ্বাদশীতেই যে ঘরে ফেরে ঘরের মানুষগুলো। যখন পুজো ফুরোয় গোটা বাংলায়, উৎসব যখন স্তিমিত, তখনই আনন্দের আলো ঢোকে ঢাকিদের গ্রামে।
আরও শুনুন: শুধুই খেলনা নয়, ছাপোষা মানুষের প্রতিবাদের প্রতীক হল তালপাতার সেপাই
তবে এখন ঢাক নিয়েও সমস্যা বেড়েছে। ভালো চামড়া মেলে না। মেলে না ভাল খোল। ঢাক ছাইতেও খরচ বাড়তি। চামড়ার ঢাকের বোল মিঠে হলেও আজকাল বহু শহুরে বাবুর তা পছন্দ না। জোরদার চটুল আওয়াজ চান তাঁরা। সেই কারণেই প্লাস্টিকে চাদরে ছাইতে হচ্ছে ঢাক। ঢাকে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠের বদলে টিনের খোল। অনেক পুজো কমিটি আবার বাতিলই করে দিচ্ছেন দুর্গাপুজোর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বাংলা ঢাককে। বেছে নিচ্ছেন রেকর্ডেড ঢাকের আওয়াজ। সিডি, ডিভিডি, ইউটিউবে বাজছে সেই ঢাক। ফলে, দিনকে দিন ঢাকির চাহিদাও খানিক কমছে। তবে কিনা এদের সংখ্যা এখনও কম। ফলে বেশ কয়েক মাস আগে থেকে প্রস্ততি নেন ঢাকিরা। আগেভাগে ঢাক সারাতে ও সাজিয়ে তুলতে হয় তাঁদের। হাত মকশো করে নেওয়ার একটা বিষয় রয়েছে।
এটুকু না করলেই নয়। মন্দের সংসারে এটুকুই তো ভাল। কে চায় বচ্ছরভর ‘বিষাদ ঠাকুর’-এর পুজোই চলুক! কেউ চায় না। পঞ্চমীতে না এলেও দ্বাদশীতেই নয় আলো আসুক ঢাকিদের গরিব ঘরে। হাসিমুখে এবার তাই ঘরে ফিরছে ঢাকিরা।