প্রতিটি শিল্পের পিছনেই সংগ্রাম থাকে। তা যে শুধু ব্যক্তিজীবনের কথা, তা তো নয়। সেখানে প্রতিমুহূর্তে জেগে থাকে সমাজ, শ্রেণি, গোষ্ঠী জীবন। ব্যক্তিগত যন্ত্রণা-ভাললাগা, সব কিছুর ভিতরে মিশে থাকে সেই অন্ত্যজ স্বর। আর সেই স্বরকেই রং-তুলিতে ধরতে চেয়েছেন দুলারি দেবী। মধুবনী বা মিথিলা চিত্র। বিহারের মিথিলা এলাকার একেবারে লোকায়ত একটি আর্ট-ফর্ম। সেই শিল্প পদ্ম-সম্মান এনে দিয়েছে তাঁকে। মিডিয়ায়, লোকমুখে ঘুরছে তাঁর নাম, তার গল্প। অথচ যে দলিত সত্তা তিনি বয়ে বেড়ান তাঁর শিল্পের শরীরে, সেই দলিত শব্দটাকে আজও কীভাবে দেখে সমাজ, প্রশাসন, দেশ! শুনে নিন, সেই দুলারী দেবীর গল্প।
দুলারী দেবী। অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া মাল্লা সম্প্রদায়ের মেয়ে তিনি। জন্মেছিলেন বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম রান্তিতে। ছোট থেকেই সঙ্গী বলতে চূড়ান্ত অনটন। সেই নিয়েই বেড়ে ওঠা। বিয়ের পরে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন দুলারী। মারা যায় শিশুটি। দুলারীকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন স্বামী। বাপের বাড়ি ফিরে আসেন দুলারী। শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কখনও দুটো টাকার জন্য রোদ-বৃষ্টিতে মাঠে কাজ করেছেন, তো কখনও লোকের বাড়ির এঁটো বাসন ধুয়েছেন।
আরও শুনুন: ডাইনি অপবাদ থেকে পদ্ম সম্মান, অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে ওঠার গল্প শোনান ছুটনি মাহাতো
একে তো তিনি মেয়ে, তার পরে দলিত। স্বভাবতই পথে কাঁটাই বেশি ছিল সর্বদা। কিন্তু এরই মধ্যে কর্পুরি দেবী নামে এক মিথিলা শিল্পীর বাড়িতে ঠিকে ঝির কাজ পান দুলারী। সেখানেই এই মধুবনী শিল্পের সঙ্গে প্রথম আলাপ তাঁর। কর্পুরী দেবীর কাছে গিয়ে আবদার করে বসেছিলেন কাজ শেখার। ফেরাননি কর্পুরি দেবী। সেই থেকে শুরু। ৬ মাসের মধ্যেই এই মিথিলা বা মধুবনী চিত্রের খুঁটিনাটি শিখে ফেললেন দুলারী দেবী। গৌরী মিশ্র নামে এক মহিলার সঙ্গে একত্রে একটি পেন্টিং ইনস্টিটিউশন চালাতেন কর্পুরি দেবী। সেখানে মাসিক ২০০ টাকা বেতনে কাজ করা শুরু করেন দুলারী। সেখানে প্রায় ১৬ বছর কাজ করেছেন তিনি।
আরও শুনুন: কীভাবে রুখবেন Domestic Violence? জেনে নিন কী সুরক্ষা দিতে পারে ভারতীয় আইন
শিল্পকে শুধু শিল্পেই আটকে রাখেননি দুলারী দেবী। তাঁর আঁকায় মিশে গিয়েছে তাঁর শ্রেণিজীবন, সমাজজীবনের জীবন্ত ছবি। মধুবনী ছবি তো অনেকেই আঁকেন। সেখানে পুরাণ থাকে, প্রকৃতি থাকে। বা সমাজের উচ্চবৃত্ত খরিদ্দারটি যা দেখতে চান, সেটুকু থাকে। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে সেই সমঝোতাটুকু কোনওদিনই করতে চাননি দুলারি দেবী। তাই মধুবনী শিল্পের যে সাবেক নকশা, তা থেকে কখনও চ্যূত হননি তিনি। কিন্তু সেসবের মধ্যেই সমাজকে, নিজের জীবনকে, নিজের শ্রেণিসত্তাকে মিশিয়ে দিয়েছেন দুলারী দেবী। তাই তাঁর ছবিতে উঠে আসে বাল্যবিবাহ, ভ্রূণহত্যা, এইডস সচেতনতার মতো সব জ্বলন্ত সমস্যা। আবার তেমনি উঠে এসেছে পুকুরের পাশের নারকেল গাছটা, রাস্তায় ধুকতে থাকা কুকুর কিংবা দাওয়ায় খুদ খাওয়া শালিক কিংবা ঘুঘুও। এখানেই আলাদা দুলারী দেবী। তাঁর প্রথম যে ছবিটি বিক্রি হয়েছিল, সেখানে মাল্লা সম্প্রদায়ের কথা এঁকেছিলেন দুলারী দেবী। মাল্লা শব্দের অর্থ নিশ্চই জানেন? যাঁরা নৌকো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাকি অংশ শুনে নিন।