সলিল চৌধুরী। বিস্ময়প্রতিভা। সংগীত যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা জানেন, সলিল চৌধুরী নিজেই একটা পৃথিবী। যে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। জন্মদিনে কিংবদন্তি শিল্পীকে তাঁরই জীবনের কিছু গল্পে শ্রদ্ধা জানালেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সময়টা ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি। ‘অন্নদাতা’ বলে একটি হিন্দি ছবিতে সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন সলিল চৌধুরী। সংগীতশিল্পী কিশোর কুমার। গানে সুরারোপ হয়ে গিয়েছে, কিশোর কুমারকে ফোন করে ডাকলেন সলিল। কিশোর কুমার এককথায় রাজি, কারণ সলিল চৌধুরীর কম্পোজিশন মানেই সমস্ত শিল্পীদের কাছে একটা আলাদা চ্যালেঞ্জ। মুম্বইতে নিজের বাসায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে কিশোরকে গানটি শোনাচ্ছেন সলিল। গানের প্রথম স্তবকটি গাওয়া শেষ হতেই কিশোর কুমার বিছানা থেকে উঠে একটু দূরে সোফায় গিয়ে বসলেন। সলিল গেয়ে চলেছেন। দ্বিতীয় স্তবকটি শেষ হতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন কিশোর কুমার। এবারে গিয়ে বসলেন ঘরের কোনায় রাখা একটি হাতলওয়ালা চেয়ারে। সলিল চৌধুরী দেখছেন কিশোর কুমারের কাণ্ডকারখানা, কিন্তু গান থামেনি তাঁর। পরের অন্তরা শেষ হল যেই, কিশোর কুমার এসে বসলেন সলিল চৌধুরীর পাশে। আর গান শেষ হতেই একেবারে মেঝেতেই বসে পড়লেন ধপ করে। সলিল বললেন, “কী হে কিশোর, অমন করছ কেন? কিছু সমস্যা হয়েছে?” একটু হেসে কিশোরের উত্তর, “আসলে সলিলদা, যেভাবে প্রতি অন্তরায় গানের স্কেল পালটে যাচ্ছে, তাতে মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়া ছাড়া উপায় নেই।”
আরও শুনুন: স্টেজে গান গাইতে বেজায় ভয় কিশোর কুমারের! কী করে তা কাটল জানেন?
যে গানটির স্কেল পরিবর্তন নিয়ে কিশোর কুমারের এহেন মজার মন্তব্য, তা হল ‘অন্নদাতা’ ছবিটির সুপারহিট গান ‘গুজর যায় দিন’। সাতের দশকের গোড়ার দিকে এ গান লোকের মুখে মুখে ফিরত।
পাশ্চাত্য মার্গসংগীতকে আত্মস্থ করে কিংবা তা অবলম্বন করে গান তৈরির ইতিহাস বহু পুরনো। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে শুরু করে এমন উদাহরণ কম নেই। কিন্তু পাশ্চাত্য সংগীত প্রয়োগ করে গানের যন্ত্রানুষঙ্গ স্বরলিপি তৈরি করা বা যাকে বলে ‘orchestration’, তা কিন্তু এসেছে সলিল চৌধুরীর মতো জিনিয়াসের হাত ধরে। কারণ তিনি নিজে ছিলেন একজন অসাধারণ যন্ত্রশিল্পীও। বাঁশি, পিয়ানো, গিটার এবং আরও বেশ কয়েকটি যন্ত্র বাজাতে পারতেন একেবারে পেশাদারি দক্ষতায়।
আরও শুনুন: ‘মানিকমামা’-র ছবিতে গান গেয়ে পারিশ্রমিক নিতেন না কিশোর কুমার
সংগীতশিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে একবার সলিল চৌধুরী ডেকে পাঠিয়েছেন গান রেকর্ডিং-এর জন্য। জটিলেশ্বর এসে দেখলেন যন্ত্রশিল্পীরা সবাই এসেছেন, কিন্তু সংগীত পরিচালক তখনও গরহাজির। এদিকে পুরো গানটাও তখনও পর্যন্ত হাতে পাননি জটিলেশ্বর। রয়েছে শুধু স্থায়ী আর প্রথম অন্তরা। একটু পরে সলিল চৌধুরী এসে ঢুকলেন স্টুডিওতে। বললেন, যন্ত্রশিল্পীদের স্বরলিপি দেওয়াই আছে, শুধু দ্বিতীয় অন্তরাটা নেই। আমি একটু আসছি। তারপরেই বেরিয়ে গেলেন হুড়মুড়িয়ে। জটিলেশ্বর কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। খানিক পর যে দরজা দিয়ে সলিল চৌধুরী বেরিয়েছিলেন, সেই দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন। দেখলেন বাইরের সিঁড়িতে কাগজ পেন নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন সলিল চৌধুরী। তবে মাত্র মিনিট দুয়েক। তারপরই ফের হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে রিহার্সাল শুরুর নির্দেশ দিলেন প্রবাদপ্রতিম সংগীত পরিচালক। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই বাকি গানটা লিখে শেষ করে ফেলেছেন তিনি। জটিলেশ্বর নিজের স্মৃতিচারণায় বলেছেন- “ধুলোর মধ্যে রোদ্দুরে সিঁড়িতে দু মিনিট বসে বাকি গানটা লিখে দিলেন সলিলদা। আমার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছিলই না! অমন অসাধারণ গান সলিলদা লিখছেন কত অবলীলায় কত সহজে!”
সত্যি কথা বলতে কী, যাঁরা ক্ষণজন্মা, তাঁরা যা করেন অনায়াসেই করেন। আর আমরা? ওই যে, জটিলেশ্বর বলে দিয়েছেন, আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই চায় না।