পুজোর মরশুম শেষ। এত আলো, এত কোলাহলের মধ্যে দিয়ে কখন যে নিঃশব্দে এসে উপস্থিত হয় অগ্রহায়ণ মাস, ভাল করে টেরও পাওয়া যায় না। কে বলবে, একসময় বাংলার দিনপঞ্জিতে প্রথম মাসের শিরোপা বরাদ্দ ছিল তারই জন্যে! আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে কথা।
আজ আমরা যে ক্যালেন্ডার মেনে চলি, তা নির্ধারিত হয় সৌরবছরের হিসেবে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবী একবার আবর্তন সম্পন্ন করে কত দিনে, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক বছরের হিসেব। আবার কোনও কোনও ক্যালেন্ডার তৈরি হয় চান্দ্র বছরের উপর নির্ভর করে। চিনারা যে দিনপঞ্জি মেনে চলেন, কিংবা ইসলাম ধর্মে যে হিজরি পঞ্জিকার প্রচলন রয়েছে, তা সূর্য নয়, চান্দ্র বছরের উপর নির্ভরশীল। এক একটি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বদলে গিয়েছে বছরের প্রথম মাসও। প্রাচীন কালে, এই বাংলার মানুষ যখন চন্দ্র-সূর্যের গতি লক্ষ করার মতো আধুনিক বিজ্ঞানের হদিশ পায়নি, তখন বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম দিয়ে বারোটি বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়েছিল। আর সেকালে বাংলা নববর্ষের সূচনা বৈশাখ মাসে ঘটত না। ঘটত অগ্রহায়ণ মাসে। কিন্তু আরও এগারোটি মাস ছেড়ে কেন অগ্রহায়ণ মাসের ভাগ্যে জুটেছিল এই খেতাব? আসছি সে কথাতেই।
আরও শুনুন: ফ্যাশন নয় আন্দোলনের অংশ, সেকালে সমাদর পেয়েছিল ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি
অগ্রহায়ণ যে একদিন বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল, নামেই তা স্পষ্ট। ‘অগ্র’ শব্দের মানে আগে, আর ‘হায়ণ’ মানে বছর। অর্থাৎ ‘হায়ণ’ বা বছরের প্রারম্ভে থাকে যে মাস, তার নাম অগ্রহায়ণ। তাই আজকের মতো নিশ্চুপে শুরু হয়ে যেত না এই মাস, বরং পয়লা অগ্রহায়ণ দিনটিকেই মানা হত সেদিনের নববর্ষ হিসেবে। আর এই দিন থেকেই শুরু হত আরও একটা নতুন বছরের দিন গোনা।
আরও শুনুন: সাহেব-বিবি-গোলাম টানা ঔপনিবেশিকতা নেই, একেবারে স্বতন্ত্র বাংলার দশাবতার তাস
আসলে, কৃষিপ্রধান বাংলা দেশে অগ্রহায়ণ বরাবরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে বাংলার প্রধান শস্য ধান ঘরে তোলে কৃষক। আমন ধান ওঠার পর সেই নতুন ধান দিয়ে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী বলেছিলেন- ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জনম তার, নাই যার চাষ।’ খনার বচনেও জানা যায়, “যদি বর্ষে আঘনে। রাজা যান মাগনে।।” অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টি হলে রাজাকে ঋণের দায়ে পড়তে হয়। কারণ, অগ্রহায়ণ মাস নতুন ফসল তোলার কাল। এই সময় বৃষ্টি হলে শস্য মাঠেই নষ্ট হয়ে যাবে, আর ফসল তুলতে না পারলে কৃষিজীবী প্রজারা রাজস্ব দেবে আর কোথা থেকে! তাহলে রাজকোশও থাকবে ফাঁকা। তাহলে, যে অঞ্চলের প্রধান জীবিকা কৃষি, নতুন ফসল তোলার মাস যে সেই অঞ্চলের মানুষদের কাছে শ্রেষ্ঠ মাসের তকমা পাবে, সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! আর সেই কারণেই, নদীমাতৃক কৃষিজীবী বাংলায় দীর্ঘদিন বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ।