শ্রমের বিনিময়ে উত্তর একটাই হয়- বেতন। ঘণ্টার, হপ্তার, মাসের জটিল অঙ্ক। কিন্তু এর বাইরেও একটা পৃথিবী থাকে। যেখানে বাস করেন মিনতি পট্টনায়েক বা বুধা শামলের মতো মানুষেরা। যেখানে যত্ন, দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে নিঃশর্ত সেবা আর পাশে থাকার কাছে ছোট হয়ে আসে বেতন শব্দটা। বা খুব কম মনে হতে পারে এক কোটি টাকার অঙ্কও। তাই রিকশাওয়ালার নামে স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেন মিনতিদেবীরা। আর বুধারা বলেন, আমৃত্যু মায়ের সেবা করে যাব। আসলে কিছু পেলে কিছু দিয়ে যেতে হয়। এ কথা মনে রাখেন ক-জনই বা। শুনে নিন মিনতিদেবী আর বুধার গল্প।
“কিছু পেলে কিছু দিয়ে দিবি,
তা নইলে পৃথিবী
চলতে-চলতে একদিন চলবে না।”– কথাগুলো বলেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
এ পৃথিবীতে আসলে কিছু পেলে কিছু দিয়েই যেতে হয়। জীবনধর্ম আমাদের তো তাই শেখায়। আমাদের লোভী মন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে। তবু ব্যতিক্রম আছে বলেই বুঝি পৃথিবীটা আজও চলছে। তেমনই ব্যতিক্রম ওড়িশার বাসিন্দা বছর তেষট্টির মিনতি পট্টনায়েক।
দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করে এসেছেন রিকশাচালক বুধা শামল। আর তার প্রতিদানে নিজের স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি বুধার পরিবারের নামে লিখে দিলেন মিনতি। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রায় এক কোটি টাকা সম্পত্তির মালিকানা পেতে চলেছেন রিকশাচালক বুধা।
আরও শুনুন: করোনাই খুলল ভাগ্যের দরজা, টিকা নিয়ে রাতারাতি কোটিপতি মহিলা
গত বছর কিডনি বিকল হয়ে মারা গিয়েছেন মিনতিদেবীর স্বামী। তাঁর মৃত্যুর পরে মেয়ের কাছেই থাকতেন মিনতি। সম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত হন একমাত্র কন্যাও। আর তাতেই এক্কেবারে একা হয়ে যান মিনতিদেবী। বেঁচে থাকার ইচ্ছা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন।
সেই কঠিন পরিস্থিতিতে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-কুটুম পাশে এসে দাঁড়াননি কেউই। মিনতির একার যুদ্ধে ‘একা কুম্ভ’-এর মতো পাশে ছিলেন শুধু সারথী বুধা। পাশে থেকেছেন বুধার পরিবারও। কোনও রকম কিছু পাওয়ার আশা, স্বার্থের তোয়াক্কা না করে দেখভাল করে গিয়েছেন মিনতিদেবীর।
গত দু-দশক ধরে বুধাদের নিঃশর্ত বিশ্বাস, ভালোবাসা ও পাশে থাকার সাম্মানিকটুকই তাই দিয়ে যেতে চান মিনতিদেবী। বাড়িঘর, সোনার গয়নাগাটি ও স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু আছে, সব মিলিয়ে মোট ১ কোটি টাকার সম্পত্তি। যার মালিকানা পেতে চলেছেন রিকশাচালক বুধা ও তাঁর পরিবার।
আরও শুনুন: নোট বাতিল হয়েছে! জানতেনই না… পুরনো নোটে ৬৫ হাজার টাকা হাতে বিপর্যস্ত বৃদ্ধ
মিনতির নিজের তিন বোন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দু-জন মিনতির এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তবে সে সব কথা কানে তোলেননি মিনতিদেবী। সমস্ত আইনি কাগজপত্র এমন ভাবেই তৈরি করেছেন মিনতিদেবী, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরে বুধাদের কোনও সমস্যা না হয়। মিনতিদেবী মনে করেন, এ বুধাদের পুরস্কার মাত্র। সম্পত্তি পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না বুধাও। জানালেন, গত দু-দশকের বেশি সময় ধরে এই পরিবারের, মায়ের দেখভাল করেছি আর আমৃত্যু করে যাব।
খবরের কাগজ খুললেই যেখানে খুনখারাপি আর বিশ্বাসহীনতার অবাধ্য শব্দের উল্লাসনৃত্য, সেখানে অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখান মিনতিদেবী আর বুধারা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, “কোথাও মানুষ ভাল রয়ে গেছে”, আজও। আর সেটুকুই যে ভরসা।