প্রথমে মনে করা হয়েছিল ছবিটি বুঝি নৃত্যরতা সুন্দরীদের। নয়ের দশকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক নাইজেল চ্যান্সেলর প্রমাণ করেন, আসলে অন্য কথা বলছে এ ছবি। তারপর থেকেই ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্টওয়ার্ক বলে চিহ্নিত করা হয় এই ছবিটিকে। কী তাৎপর্য বহন করছে ছবিটি?
স্মল পক্স বা গুটিবসন্ত রোগের নামটাই এককালে লোকের মনে ভয় ধরানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এডওয়ার্ড জেনার এই রোগের টিকা আবিষ্কার করার আগে পর্যন্ত এই রোগে কত যে মানুষের প্রাণ গিয়েছে, তার আর ইয়ত্তা নেই। এই ছোঁয়াচে রোগ একবার শুরু হলে আশেপাশে মড়ক লেগে যেত। ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার এই রোগ থেকে মুক্তির উপায় দেখালেন মানুষকে। সেই প্রথম সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে তৈরি হল ভ্যাকসিন। ক্রমে এই টিকা ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে, এমনকি ভারতেও। আর এই টিকার সঙ্গেই অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন ভারতের তিন রানি। কেমন করে? সে গল্পই বলি।
আরও শুনুন: প্রাণ হাতে করে বানানো হত হাতে-পরা ঘড়ি, মৃত্যু হয়েছিল বহু নারীর… কিন্তু কেন জানেন?
ব্রিটিশ সৈন্য টিপু সুলতানকে পরাস্ত করার পরে ওয়াদিয়র বংশ ফের মহীশূরের সিংহাসনে বসেছে, তবে ব্রিটিশদের বশ্যতা মেনে নিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন দক্ষিণ ভারতে নিজেদের অধিকার দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বিলেত থেকে আসা কর্মী বা সেনারা যাতে মড়কের শিকার না হয়, স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে কোম্পানি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গোটা সেনাবাহিনীর টিকাকরণ সারতে হবে দ্রুত।
আরও শুনুন: এক রাতেই মৃত্যু অন্তত ১ লক্ষ মানুষের, এই বিমান হামলা হার মানায় হিরোশিমাকেও
সেটা ১৮০৫ সাল। তার বছর তিনেক আগেই ভারতে এসে পৌঁছেছে জেনারের আবিষ্কৃত টিকা। ১৮০২ সালের ১৪ জুন অ্যানা ডুস্থাল নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিশুকে দেওয়াও হয়েছে সেই ভ্যাকসিন। কিন্তু টিকা ব্যাপারটাই যেহেতু অচেনা, ফলে এদেশে টিকা নিতে ভয় পাচ্ছে অনেকেই। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছিল এমন একটি বিজ্ঞাপনের, যা সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আর সেখানেই তিন রানির ভাবমূর্তি ব্যবহার করার কথা ভাবলেন ব্রিটিশ অফিসার মার্ক উইলকস। মহীশূরের রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণরাজ ওয়াদিয়র গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন বলে রাজপরিবারের মনে ভয় ছিলই। তাঁর স্ত্রী রানি লক্ষ্মী আম্মানি তাই চোদ্দ বছর বয়সেই ছেলে তৃতীয় কৃষ্ণরাজের বিয়ে দেন এমন এক মেয়ের সঙ্গে, যে গুটিবসন্ত হওয়ার পর সেরে উঠেছে, অর্থাৎ আর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই তার। কিন্তু রাজা হওয়ার পর তৃতীয় কৃষ্ণরাজ যখন আরেকটি বিয়ে করতে চাইলেন, তখন রাজপরিবার চিন্তায় পড়ে গেল। আর তখনই আসরে নামলেন উইলকস। জানালেন নতুন রানিকে ভ্যাকসিন দেওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন তিনি। শর্ত একটাই, এই টিকার বিজ্ঞাপন দিতে হবে স্বয়ং রানিদের।
সম্মত হলেন মহীশূর রাজবংশের তিন রানি। আইরিশ চিত্রকর টমাস হিকির ক্যানভাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনজন। ছবিতে ধরা পড়লেন নতুন রানি দেবযম্মানী, টিকা নিয়েছেন বোঝানোর জন্য বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরা। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন রাজমাতা এবং রাজভগিনী। এই ছবি দেখে আশ্বস্ত হয়ে টিকাকরণে রাজি হয় সেনাবাহিনী। ক্রমে ক্রমে ভারত থেকেও বিদায় নেয় এই মারণ ব্যাধি। আর তার অন্যতম অনুঘটক ছিল দুশো বছর আগের এই ছবিটি।