সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। দেবী দুর্গা কিংবা কালী দেবত্বের আবরণ সরিয়ে একান্ত আপনার হয়ে উঠেছেন তাঁর লেখায়। কিন্তু সাধারণ কেরানি রামপ্রসাদ কেমন করে পৌঁছলেন কাব্যচর্চার এই দুনিয়ায়?
শাক্ত পদাবলি লেখার জন্য তাঁকে মনে রেখেছে বাঙালি। মনে রেখেছে তাঁর লেখা আগমনি-বিজয়ার পদের জন্য। তিনি কবি রামপ্রসাদ সেন। মুখের ভাষা বাংলা হলেও, আমরা জানতাম দেবীকে আবাহন করা হয় সংস্কৃত মন্ত্রে। বিদায় জানানোও হয় ছন্দ-অলংকারবহুল সংস্কৃত বাগ্বিন্যাসে। আর এই কবি কিনা সেই দেবীকেই কল্পনা করলেন একেবারে যেন ঘরের মেয়ে হিসেবে। তাঁর কাছে মেনকা হয়ে উঠলেন বাঙালি ঘরের কোনও মা, যিনি শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়া মেয়েটির বছরে একবার বাপের বাড়িতে আসার অপেক্ষায় চোখ চেয়ে বসে থাকেন। স্বামীকে জানিয়ে দেন, “গিরি এবার উমা এলে আর উমা পাঠাব না/ বলে বলবে লোকে মন্দ, কারও কথা শুনব না।” ভক্তির গানে এমন মানবিক আবেদন তার আগে সেভাবে পায়নি বাঙালি। অথচ, বিখ্যাত এই কবি সামান্য চাকরি করতেন এক জমিদারের সেরেস্তায়। কবিত্বের ছিটেফোঁটা ছিল না সেখানকার শুকনো হিসেবনিকেশের খাতায়। তাহলে কীভাবে নিজের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন রামপ্রসাদ সেন?
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
কথায় বলে, ইচ্ছে থাকলে উপায় ঠিক হয়েই যায় একটা না একটা। এক্ষেত্রেও ঘটনা যেন কতকটা সেরকমই। কলকাতার দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তায় কাজ করতেন রামপ্রসাদ সেন। এদিকে মন তাঁর পড়ে থাকত মহামায়ার চরণে। হিসেবের খাতায় ব্যবসার তহবিলের রোজনামচার বদলে পাতার পর পাতা জুড়ে তিনি লিখে যেতেন শাক্ত পদ। এ কথা কি আর চাপা থাকে! নালিশ পৌঁছল বাবুর কাছে। নতুন কর্মচারীর কাজে তো মন নেই-ই, বরং ছাইপাঁশ লিখে হিসেবের খাতা নষ্ট করে সে। কাছারিতে এমন আকচাআকচি হয়েই থাকে। সে কথা ভেবে বাবু প্রথমটায় পাত্তা দেননি। কিন্তু নালিশের উপর নালিশ আসতে থাকলে তাঁকে তো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতেই হয়। একদিন আচমকা পরিদর্শনে এলেন দুর্গাচরণ। তুলে নিলেন রামপ্রসাদের একটি হিসেবের খাতা। সত্যিই তো, পাতার পর পাতা জুড়ে আঁকিবুঁকি। রাগে মুখ থমথমে হয়ে ওঠে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবুর। কী সব লিখেছে এই যুবক?
আরও শুনুন: পিয়ানো বাজান, ঘোড়াও চড়েন… কলকাতার পুরনো বাড়িতে এখনও নাকি দেখা মেলে ‘তেনাদের’
পড়তে গিয়ে থমকে যান দুর্গাচরণ। ‘এমন মানবজমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা’! এমন কথা তো শোনেননি কখনও! পাতা ওলটাতে গিয়ে চোখে পড়ে, ‘মা আমায় ঘুরাবি কত/ কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো/ ভবের গাছে জুড়ে দিয়ে মা পাক দিতেছ অবিরত’। বিষয়সম্পত্তি নিয়েই সারাক্ষণ মগ্ন থাকেন দুর্গাচরণ। রামপ্রসাদের এ লেখা যেন তাঁরও চোখ খুলে দেয়। ঠিক করেন, তাঁর অন্যান্য কর্মচারীদের কথামতো শাস্তিই দিতে হবে রামপ্রসাদকে। বড় শাস্তি।
চাকরি যায় রামপ্রসাদ সেনের। হালিশহরের পুরনো বাড়িতেই ফের ফিরে আসেন তিনি। না এসে গতি কী! বাবু দুর্গাচরণ মিত্র যে কড়া হুকুম দিয়েছেন, কাছারির ওই চাকরি করে যেন তাঁর কাব্যচর্চায় ব্যাঘাত না ঘটে। তাহলে পেট চলবে কী করে? সে ভাবনাও ভেবেছেন তিনি। রামপ্রসাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাসিক তিরিশ টাকা ভাতা। প্রাক্তন কর্মচারী বলে নয়, কবি বলেই তাঁর জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন দুর্গাচরণ। যাতে এই সাধক কবি এবার সম্পূর্ণ মন ঢেলে দিতে পারেন তাঁর সাধনায়।
কলকাতার সেকালের বনেদি পরিবারগুলির অন্যতম ছিল মিত্র পরিবার। ব্যবসায় রীতিমতো প্রতিপত্তি ছিল দুর্গাচরণ মিত্রের। কিন্তু আসল কথা হল, সেকালে বাঙালির বিত্ত ছিল যতখানি, চিত্ত ছিল আরও বড়। প্রতিভার প্রাপ্য সম্মান দিতে সে কুণ্ঠিত ছিল না। সেদিন সেই সম্মান জুটেছিল রামপ্রসাদের ভাগ্যে। আর তার জোরেই কবিখ্যাতির প্রশস্ত পথ খুলে গিয়েছিল তাঁর সামনে। দুর্গাচরণ মিত্রকে আমরা মনে রাখি বা না রাখি, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই।