শরতে অকালবোধন হয় বাসন্তী দুর্গাপুজোর। আর বসন্তদিনের সরস্বতী ঠাকুরের সামনে যেসব দুচোখ আরেকজোড়া চোখকে খুঁজে বেড়ায়, সেই খোঁজেরও অকালবোধন হয় শরৎকালেই। আসলে উৎসব তো ভালো থাকার দিন, ভালো রাখার দিন। উৎসবের দিনেই তাই কেমন করে যেন কাছে এসে পড়ে মানুষেরা। আর মুখেরা মিলে গেলেই সব দুঃখ সুখেরাও লন্ডভন্ড হয়ে যায় এক নিমেষে। শুরু হয় প্রেমের মরশুম।
শরতেই যে বসন্তের অকালবোধন, পঞ্জিকা আজও সে-খবর ঠিকঠাক দিয়ে উঠতে পারে না। বাঙালির মন শুধু জানে, এই সময়েও অলক্ষে কোথাও জেগে থাকে কুসুমের মাস।
সত্যি বলতে, পুজোর সঙ্গে বাঙালির প্রেম যে কী করে এমন জড়িয়ে পড়ল, কোনও প্রাচীন নথি বা পুথি সম্ভবত সে হদিশ দিতে পারে না। এমনিতে তো বাঙালির প্রেমের দিন হিসেবে একেবারে যাকে বলে ক্যালেন্ডারে লাল দাগ দেওয়া দিন হয়ে আছে সরস্বতীপুজো। শীতের নরম রোদে বাসন্তীরঙা শাড়িতেই লেখা হয় কত না নতুন প্রেমের পদাবলি! তার বেশ কিছুটা আগে, এই শরতেও যে অপূর্ব দৃষ্টিবিনিময়ে খুলে যায় হৃদয়ের নবীন দরজাখানা, সেই আখ্যান শুধু লেখা থাকে বাঙালির নিজস্ব ইতিবৃত্তে।
আরও শুনুন: লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ কি দেবী দুর্গার সন্তান?
আসলে উৎসব মানে তো মিলন। উৎসব মানে তো হাতে হাত রেখে আরও খানিক বেঁধে বেঁধে থাকা। উৎসব আসলে সেই পরিসর, যখন অবিন্যস্ত সমস্ত কিছুকে খানিকটা হলেও গুছিয়ে নিতে পারে মানুষ। এই যে মণ্ডপে মণ্ডপে জ্বলে ওঠা আলো, এই যে আঁধার পাড়া সেজে ওঠে টুনি বাল্বের জোনাকি আলোয়, সে সব কেবলই যান্ত্রিক নয়। মানুষের মনেও থেকে যায় তার অনুরণন। সাধ্য তো সকলের সমান হয় না। সামর্থ্য, অন্তত আমাদের সমাজে, চিরকালই কোনও না কোনও গণ্ডিতে বাঁধা। তবু উৎসব এসে সেই গতানুগতিকতায় বাঁধা জীবনের কানেও কানেও দিয়ে যায় আনন্দের বীজমন্ত্র। যার যেমন সাধ্য, যতটুকু সামর্থ্য, তাতেই নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়ার এই তো ক্ষণ। আর সেই পরম ক্ষণেই মনে পড়ে, আমরা তো কেউ একা নই। পাশের মানুষটাকে বাদ দিয়ে আমাদের উৎসব সম্পূর্ণ হয় না। বিপুলা এই পৃথিবীর সমস্ত মালিন্য মুছে দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবু এই তো সেই সময়, যখন সমস্ত ফুটিফাটা মেরামত করে, সমত ছেঁড়াখোঁড়া সেলাই করে নিজেরাই নিজেদেরকে একটু বিন্যস্ত করে তুলি। সাজিয়ে তুলি নিজেদের চারপাশটাকে। ব্যক্তির আনন্দবোধের সঙ্গে এই যে মিশে যায় সমষ্টির মঙ্গলকামনা, এই ম্যাজিক তো উৎসবই আমাদের শিখিয়ে দেয়। অর্থাৎ মোদ্দা কথাটা হল একটা আশ্চর্য ম্যাজিক! যে ইন্দ্রজালে বদলে যায় সময়ের প্রচ্ছদ। অদৃশ্য রং এসে লাগে সেখানে। যে রং প্রেমের। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার।
আরও শুনুন: মৃত্যু হয় হুদুড় দুর্গার, দুর্গাপুজোর সময় আজও শোকপালন করেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’
আর সেই ভালোবাসারই ছোট ছোট কবিতা লেখা হয় ব্যক্তিগত প্রেমে। হয়তো মনে কিছু দ্বিধা ছিল এই সেদিনও। হয়তো মনের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে গেছে কেউ। যার চোখ তাকে মনে পড়েছে নিশ্চিতই, কিন্তু মনের কথা থেকে গেছে মনেই। বলব বলব করেও বলা আর ওয়ে ওঠেনি। পায়ে পা জড়ানো একটু সংকোচ যেন জেগে ছিল। আশ্চর্য ম্যাজিকের মরশুম নেমে এসে সেই সবই মুছে দিয়েছে। মেঘ কেটে যেমন রোদ খেলে যায় শারদ আকাশে, তেমনই মনের জানলাতেও এই অসময়ে কোথা যেন এসে লেগেছে দখিনে হাওয়া। যেটুকু দ্বিধার খড়কুটো জমে ছিল, এই অবসরে সেটুকে সরিয়ে দেওয়া যায় বলেই হয়তো যুবতী আঙুল খুঁজে নেয় যুবক হাতের ভরসা। সত্যি বলতে, প্রেমের কোনও ম্যানুয়াল হয় না। কেন পুজোয় প্রেম হয়, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। উৎসবের মরশুম আসলে বদলে দেয় মানুষের মন। ধুয়ে মুছে দেয় গ্লানি, মালিন্য। মনের আকাশ যত সাফসুতরো হয়ে ওঠে, ততই খেলে যায় প্রেমের রংধনু। মণ্ডপের ভিড়ের মাঝেও কেমন জেগে থাকে একান্ত ব্যক্তিগত লাইটহাউস। যুবকের মন যেখানে খুঁজে নিয়েছে যুবতীর কোমল আশ্রয়। সকল ভিড়ের মাঝেও কেমন অপূর্ব একা হয়ে যেতে পারে এক একটা প্রেমের ফানুস। দুজন মানুষ, দুজন নবীন পথিক সেই ফানুসের আলোতেই পড়ে নেয় নিজেদের আগামীর পথ।
বাকি অংশ শুনে নিন।