বঙ্গভঙ্গের আমলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছিলেন ‘ভারতমাতা’ ছবিটি। দেশমাতার এক আদর্শ রূপ এই ছবি। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে এই ছবিটি জড়িয়ে গিয়েছিল। শুনে নিন সে গল্প।
বিশ শতকের শুরু। বাংলায় দানা বেঁধে উঠছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে গুপ্ত সমিতি। সকলে তার খবর রাখে না। চারদিকে যে ঘুরছে ইংরেজ পুলিশের চর। কিন্তু তাদের চোখ এড়িয়েই কোথায় কোথায় সভা বসে গোপনে, খসড়া হয়ে যায় আগামী লড়াইয়ের। এদিকে বিভিন্ন ব্যায়াম সমিতিতে ছেলেরা লাঠিখেলা শেখে, মুগুর ভাঁজে, ছোরা খেলার তালিম নেয়। মহারাষ্ট্রে যেমন শিবাজি উৎসব হয়, তার আদলে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরানী শুরু করলেন প্রতাপাদিত্য উৎসব। বাংলার নিজস্ব বীরের আশীর্বাদ নিয়ে বাংলার ছেলেরা যোগ দেবে দেশমাতার শিকল ছেঁড়ার যুদ্ধে। হঠাৎ যেন এক স্বদেশি হাওয়া উঠেছে বাংলার বুকে।
আরও শুনুন: পুলিশের মারে মৃতপ্রায়, জ্ঞান ফিরতেই কিশোরের মুখে ‘বন্দেমাতরম্’
এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ঠিক করল, ভেঙে দিতে হবে এই আন্দোলনের জোয়ার। তখন বাংলার গভর্নর লর্ড কার্জন। তিনি নির্দেশ জারি করলেন বঙ্গভঙ্গের। অনেক আগে থেকেই বাংলাকে ভাগ করার এহেন ষড়যন্ত্র চলছিল। এবার তার পালে বাতাস লাগল। বাংলার জনগণের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে কার্যকর হল বঙ্গভঙ্গ। আর এই বঙ্গভঙ্গ ঘিরেই বাংলার বুকে জোরালো হল স্বদেশি আন্দোলন।
বঙ্গভঙ্গের দিনে ঘরে ঘরে অরন্ধন পালিত হল। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষেই শুরু করলেন রাখিবন্ধন উৎসবের। বাংলার মানুষের মধ্যে যদি সম্প্রীতি না থাকে, তবে তারা হাতে হাত মিলিয়ে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে লড়বে কেমন করে! আর এই সমস্ত কাজে তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিক ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: ব্রিটিশদের তুষ্ট করতেই ‘জনগণমন’ লিখেছিলেন Rabindranath Tagore! সত্যিটা কী?
আর এই সময়েই অবনীন্দ্রনাথের শিল্পী মনে জেগে উঠল ভারতমাতার ছবি। আমেরিকান কনসালের বাড়িতে, কাকুজো ওকাকুরার সংবর্ধনা সভায় তাঁর পরিচয় হয়েছিল ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে। এই ছবির সঙ্গে অনেকখানি জুড়ে আছেন তিনি। এই ছবির নাম প্রথমে ছিল বঙ্গমাতা। পরে নিবেদিতার কথায় নাম বদলে হয় ‘ভারতমাতা’। ছবিতে দেবীর গেরুয়া বসন। চতুর্ভুজা যোগিনী মূর্তি। চার হাতে রয়েছে ধান, অর্থাৎ দেবী অন্ন দেন। অন্নপূর্ণা তিনি। আর এক হাতে বস্ত্র। সন্তানের খাদ্য বস্ত্রের অভাব নেই এই আদর্শ মাতৃগৃহে। দেবীর আর এক হাতে বিদ্যার আকর পুথি। আর অন্য হাতটিতে ধর্মসাধনার দ্যোতক জপমালা। পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে রানী চন্দকে বলেছেন, ‘আমি আঁকলুম ভারতমাতার ছবি। হাতে অন্নবস্ত্র বরাভয়। এক জাপানি আর্টিস্ট সেটিকে বড়ো করে একটা পতাকা বানিয়ে দিলে। রবিকাকা গান তৈরি করলেন, দিনুর উপর ভার পড়ল, সে দলবল নিয়ে সেই পতাকা ঘাড়ে করে সেই গান গেয়ে গেয়ে চোরবাগান ঘুরে চাঁদা তুলে নিয়ে এল।’
শোভন সোম এই ছবির ভাবনার উৎস বলে নির্দেশ করেছেন বিখ্যাত শিল্পী ইউজিন ডেলাক্রোয়া-র একটি ছবিকে। ১৮৩০-এ আঁকা সেই ছবিতে স্বাধীনতার দেবী এগিয়ে নিয়ে চলেছেন জনগণকে। স্বদেশী আন্দোলনের আবহাওয়ায় এই ছবিটি দিয়েই পতাকা তৈরি করেছিলেন জাপানি শিল্পী টাইকান।
বাকি অংশ শুনে নিন প্লে-বাটন ক্লিক করে।