কবির যত অনিচ্ছেই থাক, অপারেশন কিছুতেই আটাকানো গেল না। চিকিৎসকদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত সকলে অপারেশনেই থিতু হলেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন কবি। শিশুর সারল্যে তিনি কেবল জানতে চান, অপারেশনের সময় তাঁর বিশেষ লাগবে কি না। চিকিৎসক অভয় দিয়ে জানান, তেমন কিছুই লাগবে না। বড়জোর ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো। আশ্বস্ত হন কবি। কলকাতাতে ফিরেও চলছে কবিতা রচনার কাজ। মুখেমুখে বলে যান কবি। পাশে যে থাকে, সে লিখে নেয়। ঠিক হল ৩০ জুলাই কবির অপারেশন হবে। শুনে একটু গম্ভীর হলেন কবি। আসন্ন ঘটনার জন্য তৈরি করলেন নিজেকে। অপারেশন হল ভালোয় ভালোয়। যদিও সফল হল বলা যায় না। কবি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। ক্রমে হিক্কা শুরু হল তাঁর। পাশে থাকা নির্মলকুমারী মহালানবিশকে কাতর কণ্ঠে বলেন, তুমি আমার কেমন হেড নার্স , কমাও আমার হিক্কা। উদ্বেগ বাড়তে থাকে পরিচিত পরিসরে। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসেন কবির পত্রবধূ প্রতিমা দেবী। কবি তখন আচ্ছন্নপ্রায়। বলছেন, আর আমাকে জ্বালাস না। চারিদিক থমথমে। একে একে এসে দেখা করে যাচ্ছেন পরিচিতজন। কবি যেন সকলকেই নীরবে বলছেন, হে বন্ধু, বিদায়…। ৭ আগস্ট ১৯৪১, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। ঘনিয়ে এল বাঙালির সূর্যাস্ত। চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিমতলা শ্মশানের দিকে, তখন উত্তাল জনতা। নিয়ন্ত্রণ হারা মানুষের সমুদ্র। কবির মৃত্যুদিনে যেন নান্দনিকতা বোধেরও অপমৃত্যু। সেদিন এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন মৃণাল সেন, যে ট্র্যাজেডির অনুভব থেকে তিনি পরবর্তীতে কিছুতেই নাম বদলাতে চাননি তাঁর ছবির। বাইশে শ্রাবণ একদিকে যেন অসীম শূন্যতার দিন, তেমনই যেন আমাদের আত্মসমালোচনারও দিন।