হিন্দুধর্ম তাঁকে কী শিখিয়েছে? তিনি বলেন, শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। তারপর সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। যুক্তি পাকা হলে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই যে পদ্ধতি, তাই-ই হিন্দু ধর্মকে প্রবহমানতা দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। আর তাই তাঁর ভয় যে, এই হিন্দু ধর্মকে যদি গোঁড়া বা তালিবানি করে তোলা হয়, তাহলে সমূহ বিপদ। এমনটাই মনে করেন ব্যতিক্রমী এই আধ্যাত্মিক গুরু।
মুমতাজ আলি খান। কিংবা শ্রী মধুকর নাথ। নামে কী আসে যায়! অনুগামীরা তাঁর নামের আদ্যাক্ষর অর্থাৎ ‘ম’ বা ইংরেজিতে ‘M’ শুধু মনে রাখেন। নামের ফেরে যে মানুষ ফেরে অর্থাৎ ধর্মের যে প্রাতিষ্ঠানিক ভাগাভাগি তা তিনি অতিক্রম করে গিয়েছেন। আর তাই তাঁর কাছে ‘ম’ অর্থে মানব। ভারতবর্ষের আত্মাই যেন তাঁর জীবন। আর তাই এইসব ‘নামাবলি’ তাঁর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনও।
কেরলের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারেই তাঁর জন্ম। গুরু শ্রী মহেশ্বরনাথ বাবাজির সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রা জীবনের অভিমুখ গিয়েছিল বদলে। আর সেই থেকে জীবনের যে উপলব্ধি তাঁর সম্পদ, সেটুকুই তিনি বিলিয়ে দেন জনসাধারণের মধ্যে। দীক্ষা নিয়েছেন নাথ সম্প্রদায়ে। সেই হিসাবে বদল এসেছে নামেও। তবে নামের এই বদলকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না তিনি। কেননা, যে আধ্যাত্মিকতার পথে তাঁর যাত্রা সেখানে এগুলো তেমন গুরুত্ব বহন করে না। প্রচলিত অর্থে যাঁদের ধর্মগুরু বলা হয়, তাঁদের সঙ্গে একাসনে বসতেও তিনি নারাজ। তাঁর সাফ কথা, এই ধর্মগুরু পরিচয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অন্তত দু’রকমের বিপদ। এক তো, ধর্মগুরু যা একবার বলেন, সেটাই যেন ধ্রুব সত্যি। তিনি মনে করেন, এর ভিতরেই অহং-এর জন্ম। আর সেই অহং-এর কারণে, একজন মানুষের শিক্ষা থেকে মানুষটি অনেক বড় হয়ে যায়। তিনি সে পথে হাঁটতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, তাঁর ব্যক্তিপরিচয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং তিনি কী বলছেন, কী শিক্ষা দিচ্ছেন, সেটিই একমাত্র ধর্তব্যের বিষয়। আর তাই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকতেও তাঁর অসুবিধা নেই।
হিন্দুধর্মের যে সব গোড়ার কথা তা বরাবরই আকৃষ্ট করেছে তাঁকে। হিন্দুধর্ম তাঁকে কী শিখিয়েছে? তিনি বলেন, শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। তারপর সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। যুক্তি পাকা হলে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই যে পদ্ধতি, তাই-ই হিন্দু ধর্মকে প্রবহমানতা দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। আর তাই তাঁর ভয় যে, এই হিন্দু ধর্মকে যদি গোঁড়া বা তালিবানি করে তোলা হয়, তাহলে সমূহ বিপদ। জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রমের মতো গোঁড়া প্রথাকেও তিনি আমল দেন না। বরং মনে করেন, জন্ম নয়, কাজই হয়ে উঠতে পারে মানুষের পরিচয়।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গে জানিয়েছেন তাঁর মতামত। কার্ল মার্কসের মতবাদকে তিনি খাটো করেননি। তবে তাঁর মতে, মার্কসের দর্শন যেভাবে অর্থনীতিকে ভরকেন্দ্র করে এগিয়েছে, সেভাবে আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দেয়নি। তাঁর বক্তব্য, মার্কস যদি উপনিষদ পড়তেন তাহলে তাঁর দর্শনে বদল আসত। ডায়লেটিক্স শুধু বস্তুবাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত না বলেই, তাঁর বিশ্বাস। তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে বিরোধ নেই। এক সময় দুই জ্ঞান হাত ধরাধরি করেই চলেছে। আবার তা ফিরে উচিত বলেই মনে করেন তিনি।
জন্মগত ভাবে মুসলিম হয়েও হিন্দুধর্মের পথে হেঁটেছেন বলেই নয়, চিন্তাভাবনাতেও তিনি ব্যতিক্রমী। সন্দেহ নেই, তাঁর মত ও ভাবনা নতুন চিন্তারই রসদ জোগাচ্ছে তাঁর অনুগামীদের।