স্বস্তির সঙ্গে যেন মিশে আছে চাপা কান্নাও। ঘর গেছে। চলে গেছে আত্মীয় পরিজনরাও। যে বৃদ্ধ এই সত্তরে এসে সন্তান হারিয়েছেন, তিনি তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে। যে যুবক তাঁর একরত্তি সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচাতে পারেননি, তিনি তাকিয়ে আছেন সেই খুদের পোশাকের দিকে। একদিন যুদ্ধ থেমে যাবে। এই আশা হয়তো মরতে মরতেও মরেনি তাঁদের অন্তরে। কিন্তু যারা আক্ষরিক মরে গেল, তারা দেখে যেতে পারল না এই আপাত শান্তিকল্যাণ।
‘In what language does rain fall over tormented cities?’ – না এ-প্রশ্নের উত্তর আজও সেভাবে জানে না সভ্যতা। শুধু জানে, যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হলে বিপর্যস্ত শহরে নেমে আসে উটের গ্রীবার মতো কোনও এক নিস্তব্ধতা। ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষ-বিরতির সিদ্ধান্তে গাজা জুড়ে এখন যেন খানিক স্বস্তি, খানিক অবিশ্বাস। আর আছে চাপা দীর্ঘশ্বাস। যারা চলে গেল, এই যুদ্ধহীন নিস্তব্ধ দিন তারা তো দেখে যেতে পারল না।
প্রায় পনেরো মাস। মাথার উপর চক্কর কেটেছে যুদ্ধবিমান। সেই আতঙ্কের শব্দ যেন গাজার জনজীবনের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। এখন বন্ধ হয়েছে বিমানের আনাগোনা। আকাশ এখন শান্ত। চোখে নেমেছে ভয়হীন শান্তির ঘুম। আর এসব যেন বাস্তব জেনেও বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দাদের। যুদ্ধ যে ধ্বংস ডেকে আনে, তা শুধু বস্তুগত নয়; যুদ্ধ ধ্বংস করে মানুষের স্বাভাবিকতাকে। সহজাত বিশ্বাস, আশা, ভরসাকেই। গাজার বাসিন্দারাও তাই যেন মাস পনেরো বাদে ধাতস্থ হতে, প্রকৃতিস্থ হতে খানিক সময়ই নিচ্ছেন। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী ইজরায়েলি সেনার বন্দি-শিবির থেকে প্যালেস্তাইনের শিশু, মহিলাদের মুক্তি মিলছে। মুক্তি মিলছে রাজনৈতিক কর্মীদেরও। এ খবর আসছে গাজাতেও। বাসিন্দারা বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি বদল হয়েছে। তাতে তো স্বস্তি পাওয়ারই কথা। পাচ্ছেনও। তবে সেই স্বস্তির সঙ্গে যেন মিশে আছে চাপা কান্নাও। ঘর গেছে। চলে গেছে আত্মীয় পরিজনরাও। যে বৃদ্ধ এই সত্তরে এসে সন্তান হারিয়েছেন, তিনি তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে। যে যুবক তাঁর একরত্তি সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচাতে পারেননি, তিনি তাকিয়ে আছেন সেই খুদের পোশাকের দিকে। একদিন যুদ্ধ থেমে যাবে। এই আশা হয়তো মরতে মরতেও মরেনি তাঁদের অন্তরে। কিন্তু যারা আক্ষরিক মরে গেল, তারা দেখে যেতে পারল না এই আপাত শান্তিকল্যাণ।
তবু শেষপর্যন্ত যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আপাতত ইতি টানা গিয়েছে, তার জন্য ঈশ্বরকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তাঁরা। ধীরে ধীরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক জীবনে। অনেকের আবার মনে মনে রাগ হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার উপর। একটু আগে কি আর একটু সক্রিয় পদক্ষেপ করা যেত না! তাহলে চোখের সামনে পরিজনের মৃতদেহ দেখতে হত না! ইতিহাস সংশোধনের যুযোগ দেয় না। সে-কথা ভালোই জানেন গাজার বাসিন্দারা। যে দীর্ঘশ্বাস তাই তাঁদের বুকে জমে আছে, তা সম্বল করেই তাঁদের এখন একমাত্র আশা, এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘমেয়াদি। যুদ্ধের দিন আর যেন ফিরে না আসে, এই তাঁদের একমাত্র প্রার্থনা।
আর যারা চলে গেল? যারা এই দিনটুকু দেখে যেতে পারল না? আপাত শান্ত গাজায় শূন্যদৃষ্টি মেলে বাসিন্দারা শুধু বলছেন, ওদের মনে রেখে দেব।