কুম্ভের গুরুত্বকে কি অস্বীকার করেছেন গান্ধীজী? তা করেননি। যে লাখো ভক্ত, কুম্ভে যান, তাঁরা সকলেই যে সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেন, এমন বিশ্বাস ছিল না তাঁর। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই তীর্থ আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়।
মহাসমাগম মহাকুম্ভে। মহামিলনের ক্ষেত্র। তাই পুণ্যভূম। লাখো লাখো ভক্ত এসে জড়ো হন এই মেলায়। তাঁরা নানা মতে বিশ্বাসী। আচার-আচরণের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এক অভিযাত্রায়, এক অণ্বেষণে সকলে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। মূর্ত হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের রূপ। তবে, সেই ভারতবর্ষেরই যে গোঁড়া দিক তা অবাক করেছিল জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকেও। আর সেই সংকট তাঁর কাছে ধরা দিয়েছিল কুম্ভযাত্রার প্রেক্ষিতেই।
সেটা ১৯১৫ সাল। কুম্ভমেলায় অংশগ্রহণ উদ্দেশ্য ছিল না। ছিল বিশেষ অনুরোধ। মহাত্মা মুনশিরামজি-র সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেও ছিল। অতএব কুম্ভে যাওয়ার কথা ভাবেন গান্ধীজি। কলকাতা থেকে হরিদ্বার যাত্রা। আর এই যাত্রাপথই যেন তাঁর চোখ খুলে দেয়। আত্মজীবনীতে ‘কুম্ভ মেলা’ নামে একটি পরিচ্ছেদ রেখেছেন তিনি। সেখানেই কুম্ভ-যাত্রার প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে নিজের মতামত বেশ খোলাখুলিই প্রকাশ করেন মহাত্মা। যাত্রাপথের বিবিধ অব্যবস্থা ছিল রীতিমতো ক্লান্তিকর এবং একই সঙ্গে বিরক্তিকর। তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এই ক্লান্ত যাত্রা মানুষকে শ্রান্ত করলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্তি দেয়নি। এই ঘটনাই অবাক করে তাঁকে। তিনি এর প্রমাণ পান, যখন ক্লান্ত যাত্রার শেষে জলপানের সময়ও মানুষ ধর্মকে প্রাধান্য দিল, তখন। দেখেছিলেন, তেষ্টা মেটাতে গিয়েও যাত্রীরা খেয়াল রাখছেন যে, সেই জল মুসলমানি নয় তো! হিন্দুর জল তো! মহাত্মা লিখেছেন, “The pangs of thirst, caused by even such a journey as this, could not persuade orthodox Hindus to take water, if it was ‘Musalmani.’ They waited until they could get the ‘Hindu’ water.” আর এখানেই তাঁর প্রশ্ন। তাঁর বক্তব্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই গোঁড়ামিকে প্রাধান্য দেন এই মানুষরা? উত্তর, না। সেখানে চিকিৎসা ধর্মই প্রধান। ফলত কে জল দিচ্ছেন, তিনি কোন ধর্মাবলম্বী তা মুখ্য নয়। তীর্থযাত্রার প্রেক্ষিতেই মানুষের এই সংকীর্ণতা ভাবিয়েছিল গান্ধীকে।
তাহলে কুম্ভের গুরুত্বকে কি অস্বীকার করেছেন গান্ধীজী? তা করেননি। যে লাখো ভক্ত, কুম্ভে যান, তাঁরা সকলেই যে সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেন, এমন বিশ্বাস ছিল না তাঁর। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই তীর্থ আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়। এবং যে ভক্তরা জ্ঞানের খোঁজে সমবেত হন, তাঁরা নিজেদেরকে অন্তর থেকে শুদ্ধ করে তোলেন। তবে একাংশের মধ্যে থেকে যায় এই সংকীর্ণতা। আর তা দূর করার বিষয়েই তিনি জোর সওয়াল করেছিলেন। কুম্ভের জন্য আত্মজীবনীতে তিনি যে জায়গা রেখেছিলেন, তা বোধহয় এই উদারতার কথা উত্তরকালকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যেই।
আজও কুম্ভে জ্ঞানের খোঁজে, মুক্তির খোঁজে যান মানুষ। এমনকী আধুনিক পেশাদার যখন কুম্ভের পথে গিয়ে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পান, তখন বোঝা যায় চিরন্তন ভাবধারা আর ঐতিহ্যের মিলনমেলা হয়ে উঠতে চাইছে এই তীর্থক্ষেত্র। তবে, তা সত্ত্বেও ওই সংকীর্ণতা কি অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে? সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে যেন এ প্রশ্ন আরও বেশি করেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।