স্বামীজি যে সময় অন্য ভারতবর্ষের কল্পনা করছিলেন, তা আজকের ভারতের থেকে অনেকটাই বেশি প্রসারিত ছিল। স্বামীজির আদর্শ দ্বারা নির্মিত ভারতবর্ষ থেকে আজকের ভারতবর্ষ ঠিক কতটা পিছিয়ে আছে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
নিজের চরিত্রের ত্রুটি সম্পর্কে স্বামীজি হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে দেওয়া এক চিঠিতে লিখছেন,
‘হে বন্ধু, আপনি আমাকে স্বপ্নবিলাসী কিংবা কল্পনাপ্রিয় বলিয়া অবশ্য মনে করিতে পারেন, কিন্তু এইটুকু অন্ততঃ বিশ্বাস করিবেন যে, আমি সম্পূর্ণ অকপট; আর আমার চরিত্রের সর্বপ্রধান ত্রুটি এই যে, আমি আমার দেশকে ভালবাসি, বড় একান্তভাবেই ভালবাসি।’
আমরা জানি, স্বপ্ন না দেখলে দেশকে ধারণ ও ধারণা করা যায় না। আজও গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হলে, যুক্তিক্রম ব্যর্থ হলে, আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠে কল্পনা। আর স্বামীজি যে সময় অন্য ভারতবর্ষের কল্পনা করছিলেন, তখন ভিতরে-বাইরে নানা প্রতিরোধ। উনিশ শতক মোটামুটি যে পথে আলোর পথযাত্রী, স্বামীজির ভাবনা তা থেকে আরও বহুদূর প্রসারিত। তিনি খবরের কাগজে প্রকাশিত হওয়ার জন্য কাজ করতে মানা করছেন। নাম-যশ উদ্দেশ্য নয় বলে গুরুভাইদের সমর্থন করছেন। আসলে, সেই সময়ের সমাজভাবনা ও সংস্কার যেভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছিল, স্বামীজি সেই কেন্দ্র ভেঙে পরিধি আরও বাড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। চাইছিলেন নিশব্দ বিপ্লব। আমরা তাঁর দুটি চিঠি থেকে সেই ধারণা খানিক পেতে পারি। একটি চিঠিতে তিনি স্পষ্টতই তৎকালীন সমাজভাবনার বিকেন্দ্রীকরণ চাইছেন। লিখছেন,
“গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর কোন ভরসা রাখিও না। তাহাদের মধ্যে জীবনীশক্তি নাই-তাহারা একরূপ মৃতকল্প বলিলেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর-পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী-তোমাদের উপর। ভগবানে বিশ্বাস রাখ। কোন চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকি দ্বারা কিছুই হয় না। দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর, আর ভগবানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর-সাহায্য আসিবেই আসিবে। আমি দ্বাদশ বৎসর হৃদয়ে এই ভাব লইয়া ও মাথায় এই চিন্তা লইয়া বেড়াইয়াছি। আমি তথাকথিত অনেক ধনী ও বড়লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়াছি, তাহারা আমাকে কেবল জুয়াচোর ভাবিয়াছে। হৃদয়ের রক্তমোক্ষণ করিতে করিতে আমি অর্ধেক পৃথিবী অতিক্রম করিয়া এই বিদেশে সাহায্যপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইয়াছি। আর আমার স্বদেশের লোকেরাই যখন আমায় জুয়াচোর ভাবে, তখন আমেরিকানরা এক অপরিচিত বিদেশী ভিক্ষুককে অর্থ ভিক্ষা করিতে দেখিলে কত কীই না ভাবিবে? কিন্তু ভগবান অনন্তশক্তিমান; আমি জানি, তিনি আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি এই দেশে অনাহারে বা শীতে মরিতে পারি; কিন্তু হে মাদ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদের নিকট এই গরিব, অজ্ঞ, অত্যাচারপীড়িতদের জন্য এই সহানুভূতি, এই প্রাণপণ চেষ্টা-দায়স্বরূপ অর্পণ করিতেছি। যাও, এই মুহূর্তে সেই পার্থসারথির মন্দিরে-যিনি গোকুলের দীনদরিদ্র গোপগণের সখা ছিলেন, যিনি গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করিতে সঙ্কুচিত হন নাই, যিনি তাঁহার বুদ্ধ-অবতারে রাজপুরুষগণের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিয়া এক বেশ্যার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন; যাও, তাঁহার নিকট গিয়া সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া যাও, এবং তাঁহার নিকট এক মহা বলি প্রদান কর; বলি- জীবন-বলি তাহাদের জন্য, যাহাদের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাহাদের তিনি সর্বাপেক্ষা ভালবাসেন, সেই দীন দরিদ্র পতিত উৎপীড়িতদের জন্য।তোমরা সারা জীবন এই ত্রিশকোটি ভারতবাসীর উদ্ধারের জন্য ব্রত গ্রহণ কর, যাহারা দিন দিন ডুবিতেছে।”
আর এই ব্রত সম্পূর্ণ হবে কী করে? চাই শিক্ষা। অন্যত্র তাই লিখছেন,
“জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা। আমাদের সমাজসংস্কারকগণ খুঁজিয়া পান না-ক্ষতটি কোথায়। বিধবা-বিবাহের প্রচলন দ্বারা তাঁহারা জাতিকে উদ্ধার করিতে চাহেন। আপনি কি মনে করেন যে, বিধবাগণের স্বামীর সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে? আমাদের ধর্মের কোন অপরাধ নাই, কারণ স্মৃতিপূজায় বিশেষ কিছু আসে যায় না। সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি- যাহারা কুটিরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান-প্রত্যেকের পায়ের তলায় পিষ্ট হইতে হইতে তাহাদের মনে এখন এই ধারণা জন্মিয়াছে যে, ধনীর পদতলে নিষ্পেষিত হইবার জন্যই তাহাদের জন্ম। তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ব- বোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে। মূর্তিপূজা থাকিবে কি থাকিবে না, কতজন বিধবার পুনর্বার বিবাহ হইবে, জাতিভেদ-প্রথা ভাল কি মন্দ, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার আমার প্রয়োজন নাই। প্রত্যেককেই তাহার নিজের মুক্তির পথ করিয়া লইতে হইবে। রাসায়নিক দ্রব্যের একত্র সমাবেশ করাই আমাদের কর্তব্য-দানাবাঁধার কার্য ঐশ্বরিক বিধানে স্বতই হইয়া যাইবে। আসুন, আমরা তাহাদের মাথায় ভাব প্রবেশ করাইয়া দিই-বাকিটুকু তাহারা নিজেরাই করিবে। ইহার অর্থ, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতেও অসুবিধা আছে। দেউলিয়া গভর্নমেন্ট কোন সহায়তা করিবে না, করিতে সক্ষমও নহে; সুতরাং সেদিক হইতে সহায়তার কোন আশা নাই।
ধরুন, যদি আমরা গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিতে সক্ষমও হই, তবু দরিদ্রঘরের ছেলেরা সে-সব স্কুলে পড়িতে আসিবে না; তাহারা বরং ঐ সময় জীবিকার্জনের জন্য হালচাষ করিতে বাহির হইয়া পড়িবে। আমাদের না আছে প্রচুর অর্থ-না আছে ইহাদিগকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করিবার ক্ষমতা। সুতরাং সমস্যাটি নৈরাশ্যজনক বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু আমি ইহারই ‘মধ্যে একটি পথ বাহির করিয়াছি। তাহা এই-যদি পর্বত মহম্মদের নিস্ট না-ই আসে, তবে মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে। দরিদ্র লোকেরা যদি শিক্ষার নিকট পৌছিতে না পারে (অর্থাৎ নিজেরা শিক্ষালাভে। তৎপর না হয়), তবে শিক্ষাকেই চাষীর লাঙ্গলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যত্র সব স্থানে যাইতে হইবে। প্রশ্ন হইতে পারে যে, কিরূপে তাহা সাধিত হইবে? আপনি আমার গুরুভ্রাতাগণকে দেখিয়া থাকিবেন। এক্ষত্রে ঐরূপ নিঃস্বার্থ, সৎ ও শিক্ষিত শত শত ব্যক্তি সমগ্র ভারতবর্ষ হইতে আমি পাইব। ইহাদিগকে গ্রামে গ্রামে, প্রতি দ্বারে দ্বারে শুধু ধর্মের নহে, পরর শিক্ষার আলোকও বহন করিয়া লইয়া যাইতে হইবে। আমাদের মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিধবাদিগকে শিক্ষয়িত্রীর কাজে লাগাইবার গোড়াপত্তন আমি করিয়াছি।
মনে করুন, কোন একটি গ্রামের অধিবাসিগণ সারাদিনের পরিশ্রমের পর গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া কোন একটি গাছের তলায় অথবা অন্য কোন স্থানে সমবেত হইয়া বিশ্রম্ভালাপে সময়াতিপাত করিতেছে। সেই সময় জন-তুই শিক্ষিত সন্ন্যাসী তাহাদের মধ্যে গিয়া ছায়াচিত্র কিংবা ক্যামেরার সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রাদি সম্বন্ধে কিংবা বিভিন্ন জাতি বা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে ছবি দেখাইয়া কিছু শিক্ষা দিল। এইরূপে গ্লোব, মানচিত্র প্রভৃতির সাহায্যে মুখে মুখে কত জিনিসই না শেখান যাইতে পারে দেওয়ানজী! চক্ষুই যে জ্ঞানলাভের একমাত্র দ্বার তাহা নহে, পরন্তু কর্ণ দ্বারাও শিক্ষার কার্য যথেষ্ট হইতে পারে। এইরূপে তাহারা নূতন চিন্তার সহিত পরিচিত হইতে পারে, নৈতিক শিক্ষা লাভ করিতে পারে এবং ভবিষ্যৎ অপেক্ষাকৃত ভাল হইবে বলিয়া আশা করিতে পারে। এটুকু পর্যন্ত আমাদের কর্তব্য-বাকিটুকু উহারা নিজেরাই করিবে।”
আজ যখন জাতি-ধর্ম বিধানে আবার সমাজ কুক্ষিগত, রাজনীতি ধনিক শ্রেণির ইশারাতেই চলছে, তখন স্বামীজির স্বপ্নের ভারতবর্ষ যেন আমাদের থেকে ক্রমশ দূরেই সরে যাচ্ছে। সেই আদর্শ পুনরুদ্ধার ছাড়া আমাদের দেশ-কল্প সম্পূর্ণ হবে না।