পথের পাঁচালী- বই থেকে ছবি, সর্বত্রই দুর্গার থাকা আর না-থাকা নিয়ে একরকম টানাপোড়েন চলেছে। কাহিনিতে তার ঠাঁই হবে কি না, তা-ই যেন সহজে নিশ্চিত হয়নি। সে দ্বন্দ্ব শেষ করে দুর্গার পাঁচালিতে চিরকালের মতো ঠাঁই করে নিলেন উমা।
অকালবোধন নয়, অকালমৃত্যুতে বিসর্জন হয়েছিল দুর্গার। দেবী নয় সে, সে সামান্য এক মানবী, যার গায়ে লেগে থাকে দুঃখ-অপমানের ধুলো। তবুও, অপমান আর অবহেলার নুড়ি আঁচলে বাঁধা থাকলেও তাকে ছাড়া পথের পাঁচালী হয়ে ওঠে না। অপু যাতে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে তার কাঙ্ক্ষিত বিরাট বিশ্বের স্বাদ পেতে পারে, সেজন্য জরুরি ছিল তার সমস্ত পিছুটানের আলগা হয়ে যাওয়া। সেই মুক্তির সূচনা তো দুর্গার মৃত্যুতেই। আর সেই অপরিহার্য দুর্গাকে যিনি ছবিতে রূপ দিলেন, তিনি উমা দাশগুপ্ত। অথচ পথের পাঁচালী- বই থেকে ছবি, সর্বত্রই দুর্গার থাকা আর না-থাকা নিয়ে একরকম টানাপোড়েন চলেছে। কাহিনিতে তার ঠাঁই হবে কি না, তা-ই যেন সহজে নিশ্চিত হয়নি। সে দ্বন্দ্ব শেষ করে দুর্গার পাঁচালিতে চিরকালের মতো ঠাঁই করে নিলেন উমা।
বস্তুত, পথের পাঁচালী যখন লিখছেন বিভূতিভূষণ, তার প্রথম খসড়ায় দুর্গা কোথাও নেই। জমিদারি সেরেস্তায় কাজ নিয়ে যেতে হয়েছিল দূর ভাগলপুরের বিস্তীর্ণ এক বনাঞ্চলে। সেই একলা দিনে থাকতে থাকতে লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম উপন্যাসটি। যে উপন্যাস এবং তা অবলম্বনে পরবর্তী কালের ছায়াছবিতে জীবন্ত হয়ে রইল এক অবাধ্য আনমনা অস্থির কিশোরী, আর যার মৃত্যু বাঙালির মনে চিরজীবনের জন্য গেঁথে গেল তারসানাইয়ের সুরে- সেই দুর্গা ছিলই না পথের পাঁচালীর প্রথম পর্বে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করে চলা রুশতী সেন এ প্রসঙ্গে জানান লেখক পরিমল গোস্বামীর সাক্ষ্য। তাঁর কথায়, ‘বিভূতিবাবু আমাকে বললেন, “পথের পাঁচালী যখন প্রথম লিখি, তাতে দুর্গা ছিল না। শুধু অপু ছিল। একদিন হঠাৎ ভাগলপুরের রঘুনন্দন হলে একটি মেয়েকে দেখি। চুলগুলো তার হাওয়ায় উড়ছে। সে আমার দৃষ্টি এবং মন দুই-ই আকর্ষণ করল—তার ছাপ মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেল, মনে হলো, উপন্যাসে এ মেয়েকে না আনলে চলবে না। পথের পাঁচালী আবার নতুন করে লিখতে হলো এবং রিকাস্ট করায় একটি বছর লাগল।’ (বিভূতিভূষণ: দ্বন্দ্বের বিন্যাসে, ১৯৯৮, প্যাপিরাস, কলকাতা)
বন্ধু যোগেন্দ্রনাথ সিংহকেও বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, ‘‘মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, চোখে উদ্দেশহীন চাহনি, অথচ মুখে দুষ্টুমির চিহ্ন। মনে হয় স্কুল থেকে পালিয়েছে, নয়তো বাড়ি থেকে মেরে তাড়িয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু দুষ্টুমির মতলব আঁটছে।’’
বিভূতিভূষণের সেই দুর্গা যখন বইয়ের পাতা থেকে উঠে এল পর্দায়? তখনও কিন্তু দুর্গাকে পাওয়া একেবারে সহজ হয়নি। কিশোর অপুর জীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মেয়ে লীলাকে তো ট্রিলজিতে রাখেনই নি সত্যজিৎ। দুর্গার ভাগ্যে অবশ্য তেমনটা হয়নি। কিন্তু দুর্গাকে পাওয়া যাবে কোথায়? সেই হদিশ শেষমেশ দিয়েছিলেন আশিস বর্মন। তিনি লেখক, সত্যজিতের সহকারীও বটে। কোনও কাজে বেলতলা হাই স্কুলে একজন শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই উমা দাশগুপ্তকে দেখতে পান। মেয়েটির নাম ঠিকানা নিয়ে এসে সে খবর দেন সত্যজিৎ রায়কে। সত্যজিৎও অবিলম্বে তাকে বাড়িতে আসার কথা বলেন। তারপর কী হয়েছিল, সে কথা বিজয়া রায় জানিয়েছেন ‘আমাদের কথা’ বইয়ে-
“যথাসময়ে উমা এল। বয়স এগারো-বারো হবে। বেশ সেজেগুজে, গলায় মুক্তোর মালা পরে যখন ও ঘরে ঢুকল, আমি ওকে দেখে কোনও রকমেই দুর্গা বলে ভাবতে পারিনি। মানিক ওর সঙ্গে কথা বললেন। বেশ সপ্রতিভ ও চটপটে মেয়ে। আমার উপর আদেশ হল ওকে গাছকোমর শাড়ি পরিয়ে টেনে চুল বেঁধে ওঁদের কাছে হাজির করা। আমি ওকে সাজাতে সাজাতে বুঝতে পারলাম, এত ভালো দুর্গা আর পাওয়া যাবে না। বড় সুন্দর চোখ, নাক আর ঠোঁট। তা ছাড়া চেহারাও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। ঠিকমতো সাজিয়ে যখন বসবার ঘরে নিয়ে গেলাম, মানিক হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই তো দুর্গা!'”
সত্যজিতের মনে-ধরা সেই দুর্গা এবার পাড়ি দিলেন অন্য পথে। তবে পথের পাঁচালিতে তিনি রয়ে গেলেন চিরদিনের জন্যই।