ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
সাধের ছোটোবেলা ,
আশা করি তুই ভালোই আছিস, আমার শরীর ও আত্মার মধ্যেই লুকিয়ে আছিস। মাঝেমধ্যেই ক্ষণিকের জন্য তোকে উপলব্ধি করতে পারি, অনুভব করতে পারি। কিন্তু শত চেষ্টা করলেও তোকে ফিরে পাই না। তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রায়শই ছুটে চলে যাই সেই অতীতের সরু গলি দিয়ে, হাজির হই সেই পুরানো শালকাঠের দরজাটার সামনে, তারপর স্মৃতির মরচে পরা কড়ায় লাগানো জেদি তালাটি খুলে এক ছুটে সেই চিলেকোঠার ঘরে, যেখানে তোর সঙ্গে কাটানো মূল্যবান সময়গুলো মাকড়সার জালের মতো আকড়ে ধরে রয়েছে আজও।
ধুলো জমেছে সেইসব দিনের স্মৃতি জমা ওই লোহার বাক্সগুলোতেও। ‘পেটকাটি’, ‘চাঁদিয়াল’, ‘মোমবাতি’… মুখপোড়া দুয়েকটি পুরানো কাঠের আলমারির পিছন থেকে যেন মুচকি হাসছে। তোকে সেই মুহূর্তে বেশ ভালোভাবে অনুভব করতে পারি কিন্তু স্পর্শ করতে পারি না।
চিলেকোঠার এক কোণে উইপোকার দখলে জীবনের প্রথম ক্রিকেট ব্যাট তোর স্মৃতি আরো উসকে দেয়। একতলার উঠোনের দিকে তাকালেই যেন তোকে দেখতে পাই; বাবার কাছে আবদার করে পাওয়া সেই ফুটবলটা নিয়ে তুই দাঁড়িয়ে আছিস আর আমায় ডাকছিস খেলার জন্য, প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে উঠোনে হাজির হই কিন্তু কিছুই আর পাই না।
মনে পড়ে, পাড়ার সেই ছোট মাঠটার কথা, যেখানে তুই আর আমি কত দাপাদাপি করতাম, সেখানেও গেলাম তোকে ফিরে পাবার জন্য। হতাশ হলাম, যে মাঠের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে ছিল আমাদের দিনযাপনের ইতিকথা সেই মাঠ আজ কংক্রিটের বহুতলের করালগ্রাসে চলে গেছে। তোকে আর খুঁজে পেলাম না।
স্মৃতির আর্কাইভে রাখা চেনা অলিগলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখি হাতছানি দিয়ে ডাকছে স্কুলবাড়ি, মনটা কেমন যেন এক অজানা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গেল। মনে হল, স্কুলবাড়ির সেই দক্ষিণখোলা খিড়কির দরজাগুলো দিয়ে তুই আমায় ডাকছিস- ‘এই তাড়াতাড়ি আয়, ফার্স্ট পিরিয়ডটা এখনই শুরু হবে, দেরি হলে ক্লাসের বাইরে নিলডাউন করে রেখে দেবে কিন্তু…’ – প্রাণপণে দৌড়ে হাজির হলাম স্কুলের ভিতরে, তোর সেই গন্ধ অনুভব করতে পারছিলাম, মনে হচ্ছিল তুই খুবই কাছাকাছি আছিস, আমার সামনেই আছিস, বন্ধুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে একটি বেঞ্চে বসার দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কাঠের প্রাচীন সিঁড়িগুলো যেন দু’হাত দিয়ে আমাকে ডাকছিল- ‘আয় চলে আয়, ফিরে চল ছোটোবেলায়।’ আমি ভাবলাম বুঝি এইবার আমি তোর কাছে ফিরে যেতে পারব ।
হঠাৎই মোহভঙ্গ হল, স্কুলবাড়ির জোরালো ঘণ্টার আওয়াজে, আজকের মতো স্কুল ছুটি ।
তোর দেখা না পেয়ে ভারাক্রান্ত মনে বাড়ির পথ ধরলাম।
জানিস আমি ভালো নেই, আমি তোর সঙ্গেই ভালো ছিলাম। আমি আবার তোর সান্নিধ্যে আসতে চাই, তোকে ফিরে পেতে চাই, আমার আত্মার মধ্যেই তোকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
আমার সাধের ছোটোবেলা তুই ভালো থাকিস, আবার একদিন ঠিক দেখা হবেই।