ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
তুই তখন হাফপ্যান্ট। হাতে প্লাস্টিকের বল। মাঠে গেলেই যেটা ফুটবলত্ব পাবে। তাই কানে কথা ঢুকেছিল কম। অথচ মনে ঢুকেছিল– ‘সব দত্যি-দানো, ভূত-প্রেত এর যম হল আলো। আলো জ্বালালেই তারা উধাও, নেভালেই তারা আছে। ওরা আসলে আমাদের মনেরই জমাট বাঁধা অন্ধকার। আমরা যখন নিজেদের আলো খুঁজে পাই না, ওরা তখন আমাদের তাড়া করে। আলো খুঁজতে বাধ্য করে। ‘ মা বলেছিল। কিছুই নেই এই সহজ সত্যিটা বাবা বারবার বললেও মা চিরকাল আলোছায়ার গল্পে রাখত তোকে। ‘কিছুই নেই’ জানলে যে ভয়াবহতা তৈরি করে নেয় শিশুমন, সেই ভয়াবহতা ম্লান হয়ে আসত মায়ের গল্পে। মা জানত ভয় সকলের আছে। সেই ভয় নিজেদের তৈরি। অন্যের তৈরি ভয়ের থেকে নিজের তৈরি ভয়েরা তাই গিলে ফেলে বেশি। সেটা না হতে দিতে চেয়েই গল্পগুলো।
‘Reality is for people who lack imagination’ – মিয়াজাকি বলেছিলেন। তোর কল্পনারা তো দৌড় শুরু করেছিল ছেলেবেলাতেই। মায়ের হাত ধরে। মায়ের গল্পে আলো জ্বলার পরে সমস্ত ভয়ানকরা অদৃশ্য। তারা চারপাশে থাকলেও আলো তাদের ছুটির সময়। ওইসময় তারা চা খায়। গল্প করে। কতটা ভয় দেখাতে পারে আরও কে কে মিলে, কতজনকে- সেই প্ল্যান বানায়। তুই তো সেসব মজার গল্প শুনেছিলি, ভাবতিস, বল?
মায়ের গল্পে অন্ধকার হলেই ছায়ারা তেড়ে আসত না। তারা জমতে সময় নিত, জীবনের দুঃখের মতো। জমাট বাঁধার পরে হুঙ্কার দিত বারবার। জানাত, আমি আসছি। তুই সময় পেতিস পালানোর। নিজেকে লুকিয়ে ফেলার। আলোর সুইচ খুঁজতিস সেসময়। আজও আমাদের বিষাক্ত সব ক্ষত আর অভিমানেরা সেই জমাট বাঁধা কালো হয়ে ছুটতে থাকে, ছুটতেই থাকে। ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে আমাদের। সেই অন্তহীন দৌড়ে ছেলেবেলার গল্পগুলো, আলোর সুইচ হয়ে তখন জিয়নকাঠি।
বড়বেলায়, এখনও কোনও অন্ধকার ঘর বা সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে গেলে দৌড়োতে প্রস্তুত হই মনে মনে। আলোর সুইচ খুঁজে পেলেই হারিয়ে দেব সবাইকে, ভাবি। দৌড়ই না শুধু। বুঝি, মা জীবনের জন্য তৈরি করছিল আমায়, তৈরি করছিল আমার কল্পনাও।
আজ মা-ও সেই গল্প বলাতেই থেকে গেছে। স্মৃতি হয়ে, কল্পনায়। তুই তো মাকে পাস এখনও। গল্পগুলো শুনিস। শেষ হলে মাকে জড়িয়ে ধরিস জাপটে। আমার হয়ে।