ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
ছোটোবেলার গার্গী,
কত বদমাইশি করতিস তুই! মার কম খেতিস তার জন্য মায়ের কাছ থেকে! উফ্, কী যে জ্বালাতিস! কী করে পারতিস তুই! মনে আছে, মাসির বাড়ি গিয়ে দাদাদের যখন দেখতিস টিভির ঘরে বসে ওরা গাড়ির রেসিং দেখছে, তুইও দেখতে বসতিস। কিছু বুঝিস আর নাই বুঝিস, ওই গাড়ির আওয়াজ শুনতে ভালো লাগত তোর। ব্যস, বাবাকে গিয়ে বলেছিলি যে গাড়ির রেসিং করব বড়ো হয়ে, আমিও ওরকম জামা পরে গাড়ি চালাব। বাবা শুনে বলেছিলেন, আচ্ছা। তারপর মায়ের শখের মেশিনটাকে গাড়ি বানিয়ে সারাদিনে কী উৎপাত করতিস। মা বড়ো বড়ো চোখ করে বলেছিল, আমার মেশিন যদি খারাপ হয়ে যায় পিঠে পড়বে। মেশিনকে গাড়ি বানানো বন্ধ সেই থেকে। তবে শখটা থেকেই গিয়েছিল।
ক্লাস ফাইভ। সাইকেল চালাব বলে বায়না। টিউশন থেকে বাড়ি আসতে অনেক সময় লাগে যে। কিছুদিন পরে সাইকেল চালানো শেখা শুরু। এই সাইকেল নিয়ে কী বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিলি! মা ছিল না ঘরে, স্কুল থেকে এসে সটান বেরিয়ে পড়ি সাইকেল নিয়ে। কিছুক্ষণ পরে বাড়িতে এসে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। ও বাবা! মনে মনে ভাবছি আজকে আমায় কেউ বাঁচাতে পারবে না। তারপর হঠাৎ বোম পড়ে, ঘরের চাবি হারিয়ে ফেলেছি যে। কখন হারাল, কীভাবে হারাল! এদিকে মা জিজ্ঞাসা করছে, উত্তর না পেয়ে দু-গালে থাপ্পড়। পাশের বাড়ির কাকু এসে তালা ভাঙে। সেদিন থেকে সাইকেল নিয়ে হুটহাট বেরোনো বন্ধ হয়।
প্রত্যেক রবিবার সকালবেলা দেখতাম, বাবা রঙ্গোলি দেখত। ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে দেখতে বসতাম, টিভির মধ্যে দিয়ে গান ভেসে আসছে “চাহে কোই মুঝে জংলি কহে!” ঘুম ঘুম চোখে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাম কী গো এই নায়কের? বাবা বলে, শাম্মি কাপুর। তুই গিয়ে বলতিস মা, মাসি, দিদিকে– শাম্মি কাপুরকে বিয়ে করব! মনে পড়লেই আমার হাসি পায়। তোর মনে পড়ে এগুলো!
তখন বোধহয় ৫ থেকে ৬ বছর বয়স বড়োদিনের আগের দিন মা মাসির বাড়ির যাচ্ছিল ন-মাসির সঙ্গে। তুই বাবার সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলি মাকে বাই করার জন্য। যেই মা বাসে উঠবে, রাস্তাতে কাঁদতে শুরু করেছিলি, তোকে নিয়ে যাচ্ছে না কেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে জানিস যে তুই কেন ওরকম করেছিলি! তুই তো প্রথমে খুশি ছিলি, তারপর ওরকম কান্না। কেন রে?
মাঝে তোর ময়রা হতে ইচ্ছে করেছিল। বাবা-মায়ের সঙ্গে মিষ্টির দোকানে গেলে মিষ্টির দোকানের কাকু মিষ্টি বানাতে শখ জাগত, তার থেকেও এটা বেশি দেখতে ভালো লাগত মিষ্টির বক্স বানানো। চটজলদি চারভাঁজ করে মিষ্টির বক্স বানাত কাকুগুলো। তোর শখগুলো অদ্ভুত ছিল বইকি।
তোর সঙ্গে না অনেক কথা জমে আছে! তোর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় না এখন। তবে জানিস তো, তোর ওই গাড়ির রেসিং শখটা বজায় রেখেছি। সময় পেলে মাঝে মাঝে দেখি। তবে তোর মতন দুষ্টুমি করি না এখন, আর সিঁড়ি দিয়ে দুমদাম পড়েও যাই না। তবে তোর ওই দুষ্টুমিগুলো ছিল বলেই আমি তোর কথা মনে করে হাসি আর অন্যকেও হাসাই শুনিয়ে। ডোরেমনের টাইম মেশিন থাকলে আমি যেতাম তোর সঙ্গে দেখা করতে, তা তো হবার সুযোগ নেই। তুই-ই আসিস একদিন, তোর বদমাইশি, দস্যিপনা আর সরলতা নিয়ে। বড্ড মিস করি তোকে।