ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
ডিয়ার ছোটবেলা ,
রাস্তাটা শেষ হচ্ছেই না। সেই যে শুরু করেছিলাম এখনও একই ভাবে চলছে। কখনও তেঁতুলতলার পাশে মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারে, কখনও বা গ্রামের মধ্যে, খেতের ধার বরাবর, আম জাম বাগানের পাশ দিয়ে কোন্ গাঁয়ে গিয়ে কখন যে কোথায় পৌঁছেছি নিজেই জানি না। কখনও কেউবা সঙ্গ দিয়েছে কখনও আবার পুরো একা। কত মুখ কত মুখোশ! কত রং, কত রূপ, কত রস!
কোনও একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল একান্ত আমারই পথ, একান্তই আমার; আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার পর বুঝেছি এ-পথ শুধু চলার পথ, ফেরার পথ নয়। তাও মাঝে মাঝে ফিরে তাকাই; মনের সহজ উঠোনে বসে ফিরে তাকাই; কী জানি কিছু ফেলে এসেছি কি-না।
মাঠের পাশ দিয়ে নদীর ধার বরাবর লাল মাটির রাস্তাটার একদম শুরুতে যে ইয়্যা বড় তেঁতুল গাছটা ছিল, যক্ষের মতো পাহারা দিত তেঁতুলবুড়ি! টিনের বাক্সের দিনগুলোর কথা খুব একটা মনে নেই তবে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের পাউরুটির দিনগুলো থেকেই তেঁতুলবুড়িকে বুড়ি-ই দেখেছি। নিজের নাম মনে হয় বুড়ি নিজেও ভুলে গিয়েছিল। বিগ বাবুলের বেলুন ফুলিয়ে নেভি ব্লু কালারের স্কুল ড্রেসের ঢিলেঢালা প্যান্ট আর রামধনু রঙের ক্যাবলা টি-শার্টে কাঁপাকাঁপা বুকে তেঁতুলতলায় অসহনীয় অপেক্ষা, ইংরেজি টিউশনির শেষে হাইনেক সোয়েটার,লোয়ার কার্ট চুল আর পিঙ্ক লেডিবার্ডের রাজকন্যার। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ‘কিউ চলতি হে পবন’-এর সুরে কত হাজার খানেক না লেখা চিঠি আর মিউজিকের ছন্দের একগুচ্ছ গ্রিটিংস কার্ড যখন ব্যর্থতার প্রথম সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল, হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম তেঁতুল গাছটার নিচে ।
বুড়ি রাগে বলেছিল ‘ঠিক হয়েছে, পিরিত ছুটেছে ছোঁড়ার, এবার মর ছোঁড়া, মরে যা।’
বলতে পারিনি সেদিন কিছু, তবে তেঁতুল গাছের নীচে বস্তাখানেক নুন মিশিয়ে গাছটাকে আধমরা করে বুড়িকে আচ্ছা টাইট দিয়েছিলাম ভেবে আনন্দ করার তিনদিনের মাথায় বুড়ি মরেছিল।
বুড়ির শেষ জীবনের সম্বলগুলো এখনও রেখে দিয়েছি, পরে শুনেছিলাম বুড়ির মেয়ে নাকি ওই তেঁতুল গাছেই গলায় দড়ি দিয়েছিল ভালোবাসার যন্ত্রণায়।
এখনও ও-মুখো হতে সাহস পাই না। নিজেকে খুনি মনে হয়। লেডিবার্ডের রাজকন্যার ব্যর্থতার চেয়েও বুড়ির মুখটা বেশি মনে পড়ে মনটা পাথর করে দেয়। মনে হয় বুড়ি দু’বার মরেছিল। একবার মেয়ের জন্য, একবার তেঁতুল গাছটার জন্য।
থাক ওসব কথা ।
প্রায় একযুগ আগের কথা, সবাই বলল– ‘অভিনন্দন, এগিয়ে যা জীবনে আরো’, পেটভাতের ব্যবস্থার শিকে ছিঁড়েছিল, সুদূরে। কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। সরকারি আবার মাসপয়লায় খোরাকি। উফফফ .. সব্বার কী উচ্ছ্বাস!
জীবনে লায়েক হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ পেরিয়ে নতুন রাস্তায় চলা শুরু। চলতেই লাগলাম..
নতুন ধানের তুষের আগুনের মাঝের গোল আলু পোড়ানোর গন্ধ এখন আর ভালো লাগে না বোধহয়। নাকে চিস বার্গারের গন্ধ লেগেছে যে। হাটের মেলার নতুন কেনা জামার জৌলুস আজ শপিং মলের চড়া আলোর রোশনাইয়ে চাপা। কুল তেঁতুল ওসব নাকি বেশ পুরোনো এখন দু’মিনিটেই ম্যাগি। অম্বলে মায়ের হাতের পুদিনার শরবত এখন সেকেলে, ইনো হ্যায় তো বাকি সব আউট। রাস্তার লাল মাটির লজ্জায় এখন সিমেন্টের রূক্ষতা। বন্ধুরা এখন সবুজ পুটকিতে অনলাইন। অনলাইনেই প্রতিভা দেখায় সবাই। ভিড় করে পিঠ চাপড়ানোর দর্শক এখন নাকি ভিউ দেয়। মেঠো ধুলো গায়ে মেখে রোদ খাওয়ার দিন শেষ, এখন সেনসেশন হতেই হবে, অনলাইনে কড়া টক্কর।
বাইচান্স বেড়ালের ভাগে শিকে ছিঁড়লেই ডাইরেক্ট কুমার শানু না হলে নেহা কক্কর।
বে-গুণ আমি কিছুই পারি না উদাস হয়ে রই, মন পড়ে থাকে সেই লাল মাটির রাস্তায়, সেই গাছগাছলি ভরা আঁকে-বাঁকে, সেই নদীর বুকের দামাল ছেলে হতে আজও বড্ড মন চায়।
মেঘলা রাতে লুকিয়ে রাখা স্বপ্নগুলোকে বড্ড রূপোলি লাগে। সেই তেঁতুলবুড়ি, লেডি বার্ড সাইকেল, ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক, সেই নদী, সেই ডোরেমন।
জানি, পথটা বড্ড একমুখী, তাও যদি ফেরা যায়।
দুমড়ে মুচড়ে ছুটতে বড্ড ইচ্ছে হয়, কিন্তু …
প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার অন্যমনস্কতা ভেঙে ছেলে বলে– ‘বাবা, বৃষ্টিতে ভিজলে কেমন হয়!’
মেঘগুলো সরে জোৎস্না এল মনে হয় ।
ইন্টারনেট ছুটি আজ, ভিজছি দু’জন মনের সুখে।
ছেলের চোখে সুখ নেমেছে,
মনে হয় ফিরে এসেছি আবার সে রাঙা পথে ।
দূরে কোথাও শ্রীকান্ত আচার্য বাজছে–
‘স্মৃতির বেড়া বাঁধবে যখন, পাথর হয়ে আমার মন…/ বন্ধু তোমায় বলি শোন, বুকের জ্বালা সয়ে যাব/ পথে পথে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন……’
হয়তো ‘ফিরে পাবোই’।