দেশ ছেড়ে আসা আর নতুন দেশে বসত গড়ার মাঝে সূত্র ছিল গল্পরা। সেইসব গল্প বুনে বুনেই মনোজ মিত্রের হয়ে ওঠা। চেয়েছিলেন গল্পকার হতেই, যদিও জীবন হেঁটেছে অন্য পথে। তবে জীবনের সফরের আঁকেবাঁকে গল্প কিংবা গল্প না-র দেখা হয়েই গিয়েছে বারবার। মনোজগতের সেই গল্পের ঘরেই হয়তো এবার বসত পাতলেন মনোজ মিত্র।
গোড়ার জীবনে গল্পেই যে বেঁধেছিল পূর্বরাগ, তা নিয়ে জল্পনা মনোজ মিত্রের জীবনভর। নাটুকে জীবনের দাবিতে সেইসব গল্প না-হওয়া রয়ে গিয়েছিল অনেকদিন। তবে পরিচালকের অভ্যাসেই সেইসব গল্প কিংবা গল্প না-কে বুনে গিয়েছেন তিনি। গল্প দিয়ে বোনা সেই অদ্ভুত জগতেই তাঁর আজীবনের বসত। সেই তাঁর নিজের ঘর।
সে ঘরের এক-আধ টুকরো ঝলক কখনও-সখনও সামনে এসেছে তাঁরই জবানিতে। বলেছেন, “ছোটবেলায় গল্প শুনতে, গল্প পড়তে, গল্প বলতে ভালবাসতাম। আর এই বানাতে গিয়ে এর ঘটনা ওর ঘাড়ে চাপাতাম, এর পুকুরের জল তুলে তার কুয়োয় ঢালতাম।” যদিও সে কাজটা করতে হত লুকিয়েচুরিয়ে। এমনিতেই ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসার গোলযোগে কয়েক মাস লেখাপড়ায় দাঁড়ি পড়েছিল। তার পরে বসত-হারানো মানুষদের পাখির চোখ হয়ে দাঁড়ায় নিজের পায়ে দাঁড়ানো। সুতরাং দণ্ডিরহাটের বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে যে মনোজ বেড়ে উঠছেন, তিনি জানতেন পড়াশোনা ছাড়া সাহিত্যরচনায় মন দেওয়ার কথা জানলে তাকে সময় ‘নষ্ট’ বলেই দাগিয়ে দেবে যে কেউ। কপালে জুটবে প্রবল ভর্ৎসনা। কাজেই নিতে হল ছলনার আশ্রয়। খুব ভোরে উঠে সামনে বই খুলে রেখে তার আড়ালেই চলত হাতমকশো। বাড়ির সকলেই ছেলের মনোযোগ দেখে সন্তুষ্ট, কেবল মেজোকাকার চাহনি থেকেই অবিশ্বাসের ভাঁজ মিলিয়ে যেত না কিছুতেই।
আর সেই সন্দেহটাই একদিন সত্যি হয়ে জানাজানি হয়ে গেল। স্কুলের গণ্ডি ছাড়াতে তখন আর বছর দুয়েক বাকি। মাস্টারমশায়দের উৎসাহে উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারা প্রতি মাসে বের করে একটি হাতে লেখা পত্রিকা, তার নাম ‘কল্পনা’। সেখানেই প্রকাশ পেল কিশোর মনোজের গল্প- ‘বাঁশির সুর’। হেডমাস্টারমশাই থেকে পড়শি দিদি, সকলের প্রশংসা কুড়িয়ে লেখকও খুশি। কিন্তু বাবার কাছে জানাজানি হয়ে যেতেই বাধল গোল। গল্পের ছবিতে ভিজে কাপড়ে বউ-টিকে দেখেই পত্রিকা ছুড়ে ফেলে বাবার কড়া গলায় ঘোষণা- ‘এখানে ওর লেখাপড়া হবে না। কালই ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব।’
বাবা বলেছিলেন বটে, গল্প-টল্প লিখে কিছু হবে না, তবুও স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা থেকে কলেজের দেয়াল পত্রিকা পর্যন্ত গল্প লেখার অভ্যাস চলছিলই। মনোজ মিত্র নিজেই স্বীকার করেছেন, “একুশ বছর পর্যন্ত বাসনা বয়ে বেড়িয়েছি- গল্পকার হব।” কিন্তু সে সময়ের লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর নিজের কী ধারণা? “বড়জোর সেসব ছিল গল্পের মতো। একটা বৃহৎ কিছু লিখছি- এমত সম্ভাবনা সৃষ্টি করে অচিরেই হাউইয়ের মতো ফুস! কলেজেও প্রথম দুটি বছর ব্যত্যয় কিছুমাত্র ঘটতে না দেখে ভস্মে ঘি ঢালা না বাড়িয়ে গল্পকার হবার বাসনাটিকে মাথা থেকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে মেতে উঠেছি থিয়েটার নিয়ে।” তবে সেই থিয়েটারের দুনিয়াতেও তো গল্পেরা ঘোরাফেরা করে চলে মনোজগতে। মনোজ মিত্রের লেখা ‘চাকভাঙা মধু’ নাটক নির্মাণের সময় তেমনটাই দেখেছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়। মনোজ মিত্রের সঙ্গে স্টাডি টুর করার অভিজ্ঞতা বলেন তিনি- “পুরনো এক জমিদার বাড়িতে গিয়ে আমরা একদিন ছিলাম সেসময়টায়। সে বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই মনোজ নানা রকম গল্প তৈরি করে চলেছিল। ওর বানানো গল্পের সঙ্গে বাড়ির নানা রকম চরিত্র মিলিয়েও দিচ্ছিল আশ্চর্যজনকভাবে। যিনি দেখাশোনা করছেন, তাঁকে পুরনো কর্তা বলে ঠাওর করছিল। এবং বলছিল, ওই জমিদার বাড়িতে এমনকী, ভূতও আছে! এইসব বলে এমন একটা রহস্যের হাওয়া মনোজ বানিয়ে তুলতে পেরেছিল যে, ঘণ্টা ৪-৫ বাদে আমাদের হতে লাগল, এটা সত্যিই কি না!”
আসলে গল্প যার মনে মনে বসত পেতেছে, গল্প কি তাকে চিরতরে ছেড়ে যায় কখনও! ঠিক যেমন করে চিরতরে ছেড়ে আসা দেশও রয়ে যায় মনের মধ্যেই। ২০১২ সালে ‘গল্পনা’ লিখতে গিয়ে তাই মনোজ মিত্র ফিরে যান সেই ১৯৫০ সালে। তাঁর কথায়, ‘বারো বছর বয়সে যখন হিজিবিজি লেখালেখি শুরু করেছিলাম।’ তার মাত্র তিন বছর আগেই স্বাধীনতা লাভ করেছে দেশ, আর তাঁদের মতো অজস্র পরিবার চিরতরে হারিয়েছে দেশ। সেই পঞ্চাশেই এসেছে দাঙ্গা। প্রাচীন বটগাছের মতো সহস্র শেকড় ছড়ানো পরিবারগুলো ছেঁড়া কুটিকুটি কাগজের মতো তখন উড়ছিল এ দেশে ও দেশে। সেই অভ্যাসেই কিনা কে জানে, বাবা নাকি কোনও গাছের শেকড় ছড়াতে দিতেন না- পুরনো কথা মনে করেছেন মনোজ মিত্র। দণ্ডিরহাট থেকে কলকাতা- এখান থেকে ওখানে শিকড় বদলে গিয়েছে তাঁরও। কেবল রয়ে গিয়েছে গল্প কিংবা না-গল্পেরা। শিশু মনোজের বাড়ি, দেশ আর দেশের গল্প। সে দেশ, সে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন কবেই, তবুও সেই গল্পগুলো উড়ে বেড়ায় জীবনের সফরে। আর সেই গোটা সফরটাই মনোজ মিত্রকে বলে দিয়ে গিয়েছিল- ‘জীবন যখন গল্প বানায়, অতিবড় কল্পনাও আর তার নাগাল পায় না।’