ট্রাম্পের সপক্ষে থাকতে নারাজ মহিলাদের একটা বড় অংশ। সম্প্রতি হাজার হাজার মার্কিন মহিলা শুরু করেছেন ‘৪বি’ আন্দোলন, যার মূল স্লোগান পুরুষদের সঙ্গে যৌনতা, সম্পর্ক, বিয়েতে ‘না’। পুরুষরাই চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ট্রাম্পকে জিতিয়েছেন, এই অভিযোগেই প্রতিবাদে শামিল তাঁরা।
কেউ মনে করেছেন, নিজের শরীরটাই তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র। কেউ আবার প্রতিবাদ জারি রাখতেই যৌনতায় কারফিউ জারি করেছেন। নানা মত, নানা পথ, তবে গন্তব্যের নাম কিন্তু একটাই। প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদ কার বিরুদ্ধে হচ্ছে, তা কতখানি জোরালো কিংবা কমজোরি, তা নিয়ে হয়তো কথা হতেই পারে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ কীভাবে দানা বাঁধবে, কে কেমনভাবে প্রতিবাদকে রূপ দেবেন, তার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই। তা থাকা সম্ভবও নয়। কেননা প্রতিবাদ তো আসলে কোনও ব্যক্তির নিজস্ব নির্বাচন। কেউ কেউ যেমন প্রতিবাদ করেন না, বা প্রতিবাদ করতে ভয় পান কিংবা কুণ্ঠিত হন, ঠিক তেমনই কেউ কেউ আবার প্রতিবাদে সরব হন। একজন একজন করে সেই প্রতিবাদী মানুষেরা পাশাপাশি এসে দাঁড়ান। আর সেখান থেকেই গড়ে ওঠে সমষ্টি। কিন্তু প্রতিবাদ যখন সমষ্টির, তখনও মনে রাখা জরুরি যে তার মধ্যেও ব্যক্তির স্বর রয়েছে। আর সেই স্বর তার নিজের মতো করেই কথা বলবে।
আরও শুনুন: পুরুষ বিপজ্জনক! সুরক্ষার প্রশ্নে এই ধারণা ছড়ানো কি একরকম ফতোয়া?
যেমন ধরা যাক, আহু দারিয়েই-এর কথা। ইরানের কঠোর পুরুষতান্ত্রিক বেড়ি ছিঁড়ে তিনি প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। যে দেশে মেয়েদের সারা শরীর ঢেকে রাখার ফতোয়া জারি, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে উন্মুক্ত করেছেন। আসলে তো উন্মুক্ত করেছেন প্রতিবাদকেই। তাই আহু-র উন্মুক্ত শরীর যেন নিজেই এক হাতিয়ার, যেন এক খাপখোলা তলোয়ার। তাঁর অন্তর্বাস পরে নিজের মতো করে হেঁটে চলা আসলে এক জোরালো স্লোগান- নিজের মতো থাকার। অন্য কারও নির্দেশ না মেনে কেবলমাত্র স্ব-এর অধীন থাকার। যাকে আমরা স্বাধীনতা বলে চিনি। এই হাঁটা সেই স্বাধীনতার পথে, কারাবাস কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও।
মনে করা যাক, অসম রাইফেলস-এর সেনাদের হাতে মনোরমার ধর্ষণ-মৃত্যুর পর মণিপুরের মায়েদের নগ্ন মিছিলের কথা। কিংবা কানের রেড কার্পেটে নগ্ন শরীরে ইউক্রেনের পতাকার রং বয়ে এনে সেই তরুণীর বার্তা- ‘স্টপ রেপ আস’। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানবতা লাঞ্ছিত হলে, পোশাকের শালীনতা কি আর মানুষকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে ঢেকে রাখতে পারে! যে শরীরকে ঢেকে রাখার জন্য পিতৃতন্ত্রের এত তোড়জোড়, সেই পুরুষের ক্ষমতাই আবার সেই নারীশরীরকে ইচ্ছেমতো উন্মুক্ত করছে- এই ঘটনার বিরুদ্ধে স্লোগানের মতো ফেটে পড়েছে নারীর নগ্নতা। আবার ইরানেই যেমন ঠিকমতো মাথা না ঢাকার অপরাধে মাহসা আমিনিকে মরে যেতে হয়, মাহসার মৃত্যুর পর সেই ইরানেই মেয়েরা মাথার ঢাকা সরিয়ে দেন। যে চুলের সূর্য দেখা বারণ ছিল, সেই খোলা চুল ওড়ে নিশানের মতো। আবার লম্বা চুল কেটে আগুনে আহুতি দিয়ে কেউ কেউ বুঝিয়ে দেয়, ওই পুরুষতান্ত্রিক ফতোয়াকেই জ্বালিয়েপুড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা।
আরও শুনুন: ঘরের কাজ শুধু মেয়েদের! হাসতে হাসতেই পুরুষদের শিক্ষা দিলেন সুধা মূর্তি
শুধু নগ্নতাই কি প্রতিবাদের বয়ান! মনে পড়ে আফগানভূমে ফের তালিবান শাসন শুরু হওয়ার পর মেয়েদের প্রতিবাদের কথা। মেয়েদের সর্বাঙ্গ অনুজ্জ্বল বোরখায় ঢাকতে হবে, লুকিয়ে ফেলতে হবে গলার স্বর, অবরোধের এমন একের পর এক ফতোয়া যখন ধেয়ে আসছে, সে দেশের মেয়েরা সেজে উঠেছিলেন দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে। সে পোশাক রঙে রঙে উজ্জ্বল। পাথর-চুমকি-জরিতে আলংকারিক। মেয়েদের গোটা জীবনটা বিবর্ণ করে দিতে চাওয়ার বিরুদ্ধে পোশাকই সেখানে হয়ে উঠেছিল হাতিয়ার।
সম্প্রতি আমেরিকায় ট্রাম্প ফের মসনদে ফেরার পর সে দেশে দেখা গিয়েছে আরেকরকমের প্রতিবাদ। গর্ভপাতের বিরোধিতায় আইন পাশ করানো, প্রান্তিক যৌনতার বিরোধিতা- এমন নানা মনোভাবের কারণেই ট্রাম্পের সপক্ষে থাকতে নারাজ মহিলাদের একটা বড় অংশ। সম্প্রতি হাজার হাজার মার্কিন মহিলা শুরু করেছেন ‘৪বি’ আন্দোলন, যার মূল স্লোগান পুরুষদের সঙ্গে যৌনতা, সম্পর্ক, বিয়েতে ‘না’। পুরুষরাই চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ট্রাম্পকে জিতিয়েছেন, এই অভিযোগেই প্রতিবাদে শামিল তাঁরা। তাঁদের দাবি, এবারের নির্বাচনের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁদের মতামত কোনও গুরুত্বই পায় না। সুতরাং নিজের শরীর কাকে দেবেন, সে সিদ্ধান্ত নিজের হাতেই রাখতে চান তাঁরা।
এই সমস্ত প্রতিবাদের ধারে ও ভারে পার্থক্য রয়েছে নিশ্চিতভাবেই। কিন্তু প্রতিবাদের এই নিজস্ব বয়ানগুলিই আসলে চিনিয়ে দেয় সমষ্টির প্রতিবাদের মধ্যে থাকা ব্যক্তিক স্বরকে। বুঝিয়ে দেয়, প্রতিবাদের গোড়ায় সেই ব্যক্তিক নির্বাচনের কথা রয়েই গিয়েছে, কোনও না কোনও ভাবে। তাই প্রতিবাদের কোনও বাঁধাধরা অভিধান থাকা আদতে অসম্ভবই।