স্রেফ একদিনের দীপাবলি নয়। উত্তর ভারতে পাঁচদিন ধরে পালিত হয় উৎসব। তারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ গোবর্ধন পুজো। কালীপুজোর পরেরদিনের এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে ভগবান কৃষ্ণের যোগ মেলে। ঠিক কেমন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
কালীপুজোর পরের দিন অনেকের কাছেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত উত্তরভারত এবং ভারতের অন্যান্য কিছু প্রদেশে কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে এদিন গোবর্ধন পুজোর চল রয়েছে। যার সঙ্গে ভগবান কৃষ্ণের সরাসরি যোগ মেলে। কিন্তু যেভাবে তা পালন করা হয়, তাতে একে দেবী অন্নপূর্ণার পুজো বললেও ভুল হয় না।
আরও শুনুন:
গোবিন্দভোগ, রাধাবল্লভি, গোকুলপিঠে…বাঙালির স্বাদেও সাধের কৃষ্ণ
বালক কৃষ্ণের লীলার অন্ত নেই। জন্মের পর থেকেই লীলাবিলাসে মত্ত গোপাল। পুতনা বধ থেকে কালীয় দমন, কৃষ্ণ একাই সামলেছেন সবকিছু। রক্ষা করেছেন নিজেকে। তথা নিজের গ্রামকে। তাই তাঁর দুষ্টুমী অনায়াসে ক্ষমা করে দিতেন গোকুলবাসী। কখনও পরিস্থিতি এমন হত যে, কৃষ্ণকে আর সাধারণ মানুষ ভাবতে পারতেন না কেউ। তাঁর এই লীলা বিলাসের বর্ণনা মেলে ভাগবত পুরাণে। এছাড়া আরও অনেক ধর্মগ্রন্থেই কৃষ্ণের লীলাকথন বর্ণনা করা হয়েছে। সেখান থেকেই জানা যায়, গোর্বধন পর্বত উত্তোলনের ঘটনাটি। গোবর্ধন পুজোর উৎস কৃষ্ণের এই বাল্য লীলাই। ঘটনার সূত্রপাত মথুরায়। কৃষ্ণ তখন বালকই বটে। চেহারা ছিপছিপে। বাঁশি হাতে এদিকে ওদিক ছুটে বেড়ানোই তাঁর কাজ। আর সুযোগ পেলেই গোপিনীদের উত্যক্ত করা! গোকুলের কাছেই ছিল গোবর্ধন পর্বত। আকারে বহরে সুবিশাল সেই পর্বতে গাছের কমতি ছিল না। গোকুলবাসী সেখান গোরু চড়াতে যেতেন। এদিকে তাঁরা পুজো করতেন ভগবান ইন্দ্রের। বিশ্বাস, দেবরাজের বরেই প্রতি বছর বৃষ্টি হয়। তাই তাঁকে তুষ্ট রাখতে পারলেই মঙ্গল। সেই পুজোর আয়োজন ছিল বিশাল। তা করতে হিমসিম খেতেন ব্রজবাসী। এমনই এক বছর পুজোর সময় অদ্ভুত যুক্তি সামনে আনেন কৃষ্ণ। তাঁর প্রশ্ন ছিল, কেন ইন্দ্রের পুজো করা হবে এত ঘটা করে? তার চেয়ে বরং যে গোবর্ধন পর্বত তাঁদের সারা বছর অন্ন যোগায় তার পুজো করা হোক। প্রথমে আপত্তি তুললেও একসময় তা মেনে নেন ব্রজবাসী। নির্দিষ্ট দিনে গোবর্ধন পুজোর তোড়জোড় শুরু করেন সকলে। এই ঘটনা দেখে চটে লাল ইন্দ্র। চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করেন দেবরাজ। তখনই বজ্রকে আহ্বান জানান। ক্রোধের আগুন উগরে দেন ব্রজবাসীর উপর। ভয়ঙ্কর বৃষ্টি শুরু হয় চারদিকে। ভেসে যেতে থাকে সবকিছু। সকলেই বুঝতে পারেন দেবরাজ রুষ্ট হয়ে এমনটা করছেন। কিন্তু এমনটা হয়েছে কৃষ্ণের জন্য। তাই, সকলে তাঁর কাছেই সমাধান চেয়ে ছুটে আসেন।
আরও শুনুন:
রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের ভক্তি আর পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠেই বাঙালির শ্যামা আরাধনা
কৃষ্ণ একটুও না ঘাবড়িয়ে সবাইকে বলেন গোবর্ধন পর্বতের সামনে পৌঁছতে। এরপরের ঘটনা অবাক করাই বটে। সকলকে চমকে দিয়ে ওই বিশাল পর্বত তুলে নেন কৃষ্ণ। তাও আবার হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে। ব্রজবাসী তার তলায় আশ্রয় নেন। ইন্দ্রের আর কিছু করার নেই। হাজার চেষ্টা করলেও পাহাড় ভেঙে ফেলার ক্ষমতা তাঁর নেই। বাধ্য হয়ে তিনি শান্ত হন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাও চান। আসলে, ইন্দ্রের অহংবোধ চূর্ণ করতেই এই লীলা দেখিয়েছিলেন কৃষ্ণ। তবে এই ঘটনাকে স্মরণ করে এখনও পালিত হয় গোবর্ধন উৎসব। নিয়ম অনুযায়ী, এদিন কৃত্রিম পাহাড় তৈরি করা হয়। যাতে ব্যবহার করা হয় খাদ্যসামগ্রী। ভাত, ডাল, তরকারী সহ নানা উপাচার ব্যবহার করে গড়ে তোলা এই পাহাড়কেই পুজো করা হয়। তারপর সেই খাবার সকলের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়। এই উৎসবকে অন্নকূটও বলে। যেহেতু খাবারের পুজো তাই এর সঙ্গে দেবী অন্নপূর্ণার যোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। বাঙালিদের মধ্যেও এই অন্নকূটের চল রয়েছে। তবে তা অন্যদিন। কালীপুজোর পরের দিন গোবর্ধন উৎসবেই ঘটা করে অন্নকূটের আয়োজন হয় দেশের অন্যান্য প্রান্তে।