বহু বিবর্তন কালী মূর্তিকে ঘিরে। বহু তত্ত্বের সমাহার। কালীকথাও তার ব্যতিক্রম নয়। রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের সংগীত আর পান্নালালের ঐশ্বরিক কণ্ঠই বাঙালির কালীচেতনাকে দিয়েছে অন্য রূপ।
হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতিয়েছিলেন মহাপ্রভু। আর সেই ভক্তির স্রোতে জোয়ার এনেছিলেন নিত্যানন্দ। বাঙালির ভক্তিতরঙ্গে এ যদি একটা দিকের ধারা হয়, তবে অন্যটি অবশ্যই শ্যামাসঙ্গীতের। রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের শাশ্বত শ্যামাকথা আর পান্নালাল ভট্টাচার্যের ঐশ্বরিক কণ্ঠ ছাড়া তাই বাঙালির শ্যামা আরাধনা সম্পূর্ণ হয় না।
কালী যে রূপে বাংলায় পূজিতা, তার মধ্যেও আছে সমন্বয়ের চিহ্ন। কার্তিক মাসে দীপান্বিতা অমাবস্যায় মায়ের যে রূপের আরাধনা, তার প্রচলন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাতেই। নবদ্বীপের মাটি থেকেই সেই ধারার সূত্রপাত। তন্ত্র-পুরাণে কালীর বহু রূপের সন্ধান মেলে। হিন্দুধর্ম এবং বৌদ্ধতন্ত্রের পাশাপাশি চলে আসার দরুণ আরাধ্যা কালীমূর্তি বহু তত্ত্বকথার মূর্তকথা হয়ে ধরা দেয়। কৃষ্ণানন্দ যে রূপে তাঁকে কল্পনা করলেন, তা বাঙলার আত্মার সঙ্গে যেন এক হয়ে গেল। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গেও যোগ হয়েছিল কালী আরাধনা।
এই কালীচেতনা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি হিসাবেই কালীর ভাব ছড়িয়ে দেন তিনি তাঁর অপূর্ব সংগীতের মাধ্যমে। উচ্চ ঘরানার সাধক ছিলেন রামপ্রসাদ। আর তাই বহু ভাবের প্রসঙ্গ থেকে গেল তাঁর গানের কথায়। তবে, উপমা, ভাষা আর সুরের চলনে তা এত সরল, এত হৃদয়স্পর্শী যে বাঙালির মন স্পর্শ করল এক লহমাতেই। রামপ্রসাদ বললেন, ‘জেনেছি জেনেছি তারা তুমি জান ভোজের বাজি/ যে তোমায় যে ভাবে ডাকে তাতেই তুমি হও মা রাজি’। যেন কালীসাধনার নানা ধারার সমন্বয়ের কথাটিই এখানে বলা। আবার এর মধ্যে যেন গীতার বাণীও লুকিয়ে আছে। স্বয়ং কৃষ্ণই তো বলেছিলেন, যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি। কালী আর কৃষনসাধনার ধারা যেন ভক্তের ভক্তির কাছে এক হয়ে যায়। অন্য গানে রামপ্রসাদ তাই বলেই ফেললেন, ‘ঐ যে কালীকৃষ্ণ শিবরাম, সকল আমার এলোকেশী’।
রামপ্রসাদের এই গানের ধারা যেন নতুন অভিমুখ পেয়ে প্রবাহিত হল কমলাকান্তের অনুভবে। তিনিও বললেন, ‘জান না রে মন পরম কারণ/ কালী কেবল মেয়ে নয়/ সে যে মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখনও কখনও পুরুষ হয়।/ হয়ে এলোকেশী করে লয়ে অসি/ দনুজ তনয়ে করে সভয়।/ কভি ব্রজপুরে আসি বাজাইয়ে বাঁশি ব্রজাঙ্গনার মন হারিয়ে লয়।’কথার মধ্যে সেই মহামিলনের অনুষঙ্গ থাকল, থাকল সমর্পণের ভাষাও। একই সঙ্গে সুরের ধারাও পেল নতুন বৈচিত্র। ভাবের সঙ্গে রাগের সমাহারে শাক্তসংগীতের একেবারে নতুন স্রোত বইল।
আর এই শ্যামাসঙ্গীতে ঐশ্বরিক কণ্ঠের কথা যদি বলতেই হয়, তবে বাঙালির মনে সবার উপরে থাকবেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। আধুনিক গান বা সিনেমার গান-ই গাইতে চেয়েছিলেন। তবে দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সূত্রেই শ্যামাসঙ্গীতের জগতে চলে আসেন। আর বাঙালির সুর-স্বর-সাধনাকে দিয়ে যান অমূল্য সম্পদ। মনে করা হয়, কালীর দর্শন না পাওয়ার অবসাদ থেকেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। তবে, মাতৃসাধনা আজও তাঁর গান ছাড়া যেন সম্পূর্ণ হয় না। তাঁর মতো করে আন্তরিক সমর্পণে কেই-বা আর মা উচ্চারণ করেছেন!