কালিকাপ্রসাদ। যাঁর বুকে জমে ছিল এক প্রতিবাদী আগুন। আর গান ছিল যাঁর অস্ত্র। পথে নামতে যাঁর দ্বিধা হয়নি কোনও দিন। প্রতিবাদের এক অস্থির সময়ে সেই কালিকাপ্রসাদের সঙ্গেই স্বগত আলাপ জুড়লেন সুতীর্থ দাশ।
এখন রাত অনেক। গভীর মিশকালো রাত। ভোর হতে এখনও অনেক বাকি। ঘুম আসছে না, তাই লিখতে বসেছি। জানলার ধারে বসে শুনতে পাচ্ছি মানুষের চিৎকার। ওরা আজ সারারাত পথে থাকবে; ওরা আজ সারারাত গান করবে। ওরা যে রাত দখল করেছে।
কিছুক্ষণ আগে আমিও ছিলাম ওদের পাশে। বয়েসের দাবি– ওরা যেমন সারারাত পথে থাকবে, আমি অতটা পারব না। তাই আমাকে ফিরে আসতে হল অল্প সময় থেকে। বয়সের সেই দাবি অমান্য না করে ফিরে এসেছি খানিক আগে। কিন্তু মনে মনে এই মুহূর্তে আমিও রাজপথে। শুধু আমি কেন? ভালো করেই জানি, তুমিও আছ ওদের পাশে– কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে ওরা কেউ দেখতে না পেলেও, তুমি আছ।
ওই তো, তুমি আছ আর.জি.কর হাসপাতালের সামনে ওই অল্পবয়সি ডাক্তার ছেলেমেয়েগুলোর পাশে। ওদের সাথে বসে গান করছ। তোমাকে দেখছি অ্যাকাডেমি চত্বরে। আবার, তোমাকে পরমুহূর্তেই দেখছি যাদবপুর ৮বি’তেও। ছুটে বেড়াচ্ছ তুমি শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। দু’হাত তুলে গাইতে গাইতে ছুটছ তুমি। তোমার গান এই মুহূর্তে কোনও এক জাদুমন্ত্রের বলে রূপান্তরিত হয়েছে ওদের স্লোগানে; ওদের যন্ত্রণায় মোড়া গানে।
মনে পড়ে, আজ থেকে বছর পনেরো আগের এমনই এক অস্থির সময়ের কথা। প্রতিবাদী তুমি ছুটে গিয়েছিলে এক গণমিছিলে যোগ দিতে। সেদিনও ওই মিছিলে অগুনতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন শহরের বহু খ্যাতনামা মানুষজন। সেদিনও ছিল শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সকলে চাইছিল আবার একবার নিজের সমাজটাকে নতুন করে গড়ে তুলতে। তুমিও ছিলে সেই দাবিদারদের একজন।
নিশ্চয়ই সেদিন তোমার সঙ্গে ছিলেন তোমার রবীন্দ্রনাথও। অন্তর থেকে তুমি যাঁকে ‘বন্ধু’ মনে করতে।
একবার তোমাকে কোনও এক টেলিভিশন চ্যানেলে বলতে শুনেছিলাম– তোমার রবীন্দ্রনাথ সর্বকালেই তোমার সমবয়সি হয়ে থেকেছেন। ছেলেবেলায় যেমন তুমি ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটিতে কিংবা রাখালের বাঁশির সুরে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পেয়েছিলে; তেমনই হয়তো যৌবনে কোনও এক প্রহর শেষের রাঙা আলোয় কবিকে তুমি দেখেছিলে এক যুবতির চোখে। আর তাই হয়তো সেই পনেরো বছর আগের মিছিলে, রবীন্দ্র সদনের পাশ দিয়ে হেঁটে অ্যাকাডেমি যাবার পথে, তোমার সঙ্গী হয়েছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব কবি। ভিড়ের মাঝে শক্ত করে তোমার হাতটি হয়তো ধরেছিলেন উনি। হয়তো সেদিন তুমি আর তোমার রবীন্দ্রনাথ একসাথে গাইতে গাইতে হেঁটেছিলে –
“পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!”
তোমারও বয়স সেদিন ছিল চল্লিশ। তোমার বন্ধু সেদিনও প্রায় তোমার সমবয়সি।
গঙ্গার ঢেউয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলে বরাক নদীর একটা ছোট্ট ধারাকে। তোমার অস্ত্র ছিল তোমার গান। বুকে জমে ছিল এক প্রতিবাদী আগুন। সে আগুনের তাপ যখন পুড়িয়ে দিচ্ছিল তোমার ভিতরটা, তুমি ঠিক করেছিলে পথে নামবে। তোমার সেদিনের সেই শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসলে ছিল নিজেকেই প্রশ্ন করার। তোমার ছাত্র-রাজনীতি তোমাকে শিখিয়েছিল প্রশ্ন করতে, শিখিয়েছিল প্রতিবাদ করতে। নিজের বিবেককে, নিজের মতাদর্শকে প্রশ্ন করে যখন সঠিক উত্তর খুঁজে পাওনি, তখনই ঠিক করেছিলে প্রতিবাদ করবে। অবাক করেছিলে বহু মানুষকে, কিন্তু কোনও কিছুই তোমাকে অবিচলিত করেনি সেদিন।
চিরকালই তোমার প্রত্যয় তোমাকে পথ দেখিয়েছে– সেদিনও দেখিয়েছিল। আর দেখিয়েছিলেন তোমার ‘বন্ধু’ রবীন্দ্রনাথ।
তুমি সত্তরের সন্তান– সময়ের হাত ধরে তখন এক ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে সারা বিশ্ব। একদিকে মানুষ যেমন চাঁদের মাটি নিয়ে পৃথিবীতে ফিরছে; অপর দিকে তোমার দেশের মাটির একটা খণ্ড রক্তে ভিজে লাল। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মাটি তখন আবারও একবার ভাগ হওয়ার মুখে। মুক্তির দাবিতে অস্ত্র তুলেছে সে দেশের মানুষ। তুমিও বেড়ে উঠছ সেই অশান্ত দশকে। বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও মাটির গন্ধ। একদিকে কাকা অনন্ত ভট্টাচার্যের হাত ধরে চিনে নিচ্ছ মাটির গান। তিনিও তাঁর লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারের দরজা খুলে দিচ্ছেন তোমার সম্মুখে– সবটাই উজাড় করে দিচ্ছেন তার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে। পাশাপাশি আই.পি.টি.এ’র সক্রিয় সদস্য- কাকা মুকুন্দদাস ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক আদর্শ তোমার মধ্যেও বীজ বপন করছে রাজনৈতিক সচেতনতার । চিনতে শেখাচ্ছে মাটির মানুষকে।
এভাবেই হয়তো মাটি চিনতে শিখেছ; উপলব্ধি করেছ মাটির মানুষের মাটির গান।
কিছুদিন আগে পড়শি দেশেও ঘটে গেল এক গণঅভ্যুত্থান। যে দেশে তোমারও নাড়ি বাঁধা আছে; যে দেশে তোমার গান ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে; যে দেশে তোমার ‘বন্ধু’ রবীন্দ্রনাথ এ দেশের মতনই সমানভাবে সমাদৃত। ওরাও গানে আর স্লোগানে মুখরিত করেছিল আন্দোলন। আজ তোমার রাজ্যেও প্রায় একই ছবি। তোমার শহর কলকাতাও আজ উত্তাল।
একটু আগে একটা মিছিল হেঁটে গেল সামনের রাস্তা দিয়ে। চৌমাথায় গিয়ে মিশবে এক বিশাল জনপ্লাবনে। ওই মিছিলের বৃহৎ একটি অংশে আছে আজকের এক নতুন প্রজন্ম; এক নতুন শতাব্দীর প্রতিনিধিরা। ওরা বাস্তববাদী; ওদের আবেগ একটু কম; ওদের রাগ আছে; বুকে অদম্য সাহস আছে। ওরা প্রশ্ন করে– সব বয়সের মানুষকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোনও কিছুই সহজে মেনে নেয় না। তোমার ‘বন্ধু’র ভাষায় সত্যিই ওরা ‘নূতন যৌবনের দূত’– সত্যিই ওরা চঞ্চল ওরা অদ্ভুত। কিন্তু লোকে বলে, যুগের দাবি মেনে ওরা নাকি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে ওরা এক-একজন নাকি একাই বিশ্বজয় করার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস করে। জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে দিতে চায় ওরা। ইতিহাসে ওদের প্রবল অনীহা। যন্ত্রবৎ জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কিন্তু কী অদ্ভুত দ্যাখো– ওরাও আজ দল বেঁধে পথে নেমেছে। বিচারের দাবিতে ওরাও দলবদ্ধ হয়েছে।
আজ ভীষণ প্রয়োজন ছিল তোমার। ওদের সাথে ভিড়ে মিশে নয়– সামনে থেকে ওদের নেতৃত্ব তুমিই দিতে পারতে। হয়তো আজকের এই ভয়াবহ এক সামাজিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুমিই ওদের তোমার ‘বন্ধু’ রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথটা চিনিয়ে দিতে পারতে।
তুমিই তো একদিন বলেছিলে– যে বিকৃতি আর সংকট আমাদের প্রতিদিন একটু একটু করে গ্রাস করছে, তার হাত থেকে পরিত্রাণ হয়তো রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন। তাই মনে হয়, আজ ওদের তুমিই বোঝাতে পারতে সে কথা– ওদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারতে তোমার ‘বন্ধু’র সাথে । তুমিই ওদের ভালো করে লালন চিনিয়ে দিতে পারতে। তুমিই পারতে হাসন রাজার সাথে ওদের পরিচয় করাতে। তুমিই ওদের বোঝাতে পারতে যে গান এক অস্ত্র, যার ক্ষমতা অপরিসীম, যে ক্ষমতা নিছকই কিছু ‘ভিউ’, ‘লাইক’ আর ‘সাবস্ক্রিপশন’ দিয়ে বিচার করা যায় না। মনে পড়ে গেল তোমাকে শাহ আব্দুল করিম যে কথাটা বলেছিলেন– কোনও গান যদি শুধুমাত্র তিনজন শ্রোতাও মন দিয়ে শোনে তাহলেও সে গান সার্থক। সে গান যদি ওই তিনজনের জীবনে কাজে লাগে, তাহলেই অনেক।
ধর্ম আর রাজনীতি দিয়ে মাখামাখি যে মণ্ড গেলাবার বন্দোবস্ত চলছে সেটা যে কতটা যন্ত্রণার, সেটা তুমি জানো– তুমি নিজেও খানিকটা দেখে গিয়েছ, চিন্তা প্রকাশও করেছ। এই নিয়ে বহুদিন অনেক কথা হয়েছে, তাই না?
তোমার গলা ছেড়ে গাওয়া গানের অনুরণন ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। আজ বড্ড বেশি করে তোমায় খুঁজছি। তাই তোমার আসন পেতে দিয়েছি নয়নতারায়।
মন বলছে, তুমি আছ।